বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর জীবনী
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর-রহমান এর জীবনী এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান সম্পর্কে জানব। যার আত্নত্যাগ এনে দিয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
জন্ম ও পরিচয়:
মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের মোবারক লজ এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানায়। বর্তমানে মতিউরনগর নামে পরিচিত। মতিউর রহমানের ১১ ভাইবোনের মধ্যে মতিউর ৬ষ্ঠ। তার বাবা ছিলেন মৌলভী আব্দুস সামাদ এবং মাতা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। বড় ভাই বোন ও মা বাবার আদর স্নেহে বড় হতে থাকেন মতিউর। তিনি ঢাকার নামকরা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেনি পাস করেন। এরপর তিনি সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংশন সহ মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উওীর্ন হন।
কর্মজীবনে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান:
১৯৬১ সালে মতিউর রহমান পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি রিসালপুর পি এ এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। কমিশন প্রাপ্ত হওয়ার পরেই তিনি করাচির মৌরিপুর এয়ারবেজ এর ২ নাম্বার স্কোয়ার্ডন জেনারেল পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। মেধার বিকাশ যেন ঘটতেই থাকে সাথে একের পর এত সাফল্য। এরপর তিনি জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স করেন। মোট ৩৩ টি জেট বিমান সম্পর্কে ধারনা নেন এবং সেই পরীক্ষায় তিনি ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে সফল হন। এরপর তিনি এফ ৮৬ স্যাবর জেট উপর কোর্স সম্পন্ন করেন এবং সেখানেও তিনি ৮১% মার্কস পেয়ে উওীর্ন হন। বিমানবাহিনী সম্পর্কে ভালো ধারনা লাভ করার জন্য মতিউর রহমানকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন)৷ এ প্রথম পোস্টিং দেওয়া হয়।
১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন পারদর্শী অফিসার। সব কিছুতেই ছিলো অভিজ্ঞতা। এরপর সারগোদায় চলে যান কনভার্সন কোর্সের জন্য। সেখান থেকেই তিনি একটি মিগ বিমান চালানোর সময় হঠাৎ বিমানটি বিকল হয়ে যাওয়ায় সেটি মতিউর রহমান খুব দক্ষতার সঙ্গে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরন করেন। কোন মানুষের জীবন বিপদের মুখে পড়েনি। সব কিছু একাই সামলে নিয়েছিলেন মতিউর রহমান। এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই। মতিউর রহমান ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার আয়োজিত এক সন্মান পেশোয়ারে মতিউর রহমানই ছিলেন একমাত্র দক্ষ বাঙালি পাইলট।
মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর ভূমিকা:
১৯৭১ সালে মতিউর রহমান আসেন পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। প্রায় ২ মাস তিনি তার পরিবারে সাথে থাকেন। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় হত্যাযঞ্জ।মতিউর রহমান নরসিংদী থাকার কারনে তেমন কিছু করতে না পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বাঙালি মানুষকে যুদ্ধ শিখানোর জন্য নেমে পড়লেন।সাহসিকতার সাথে খুলনায় একটি ক্যাম্প বানালেন এবং মতিউর রহমান বাঙালি সাহসিক যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন।মতিউর রহমান দৌলতকান্দিতে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করেন এবং মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারের দিকে যান। সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে তারা গড়ে তুলেছেন এক প্রতিরোধ বাহিনী। সেখানে পাক সৈন্যরা আক্রমন করা শুরু করলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ই পি আর এর সঙ্গে মিলে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বিমান বাহিনী এফ ৮৬ জেট থেকে তাদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করা হয়।মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন৷ তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তার বাহিনী৷
আবার তিনি ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা এসে সপরিবার নিয়ে করাচি যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। অসিম সাহসিকতা নিয়ে আবারও তিনি ফিরে যান কর্মস্থলে। কর্মস্থলে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এটা দিয়েই যুদ্ধ শুরু করবেন। মতিউর রহমানকে তখন বিমানের সেফটি অফিসার পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন পরিকল্পনা করে বিমান দখলের জন্য। তার সাথে থাকা পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলেই তিনি নিজের করে নেবেন বিমানটি। তিনি বিমানটির নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি ৩৩। পাইলট রাশেদ মিনহাজ দ্বিতীয় বারের মতো উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান বিমান বাহিনীর ক্ষমতাবলে বিমানটিকে থামাতে বলেন রাশেদ মিনহাজ বিমানটি থামিয়ে দেন। ক্যানোপি খুলে মতিউর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয় বিমান থামানোর কথা তখন মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেনত করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগেই রাশেদ মিনহাজ জানিয়ে দেন যে বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। ছোট পাহাড়ের আড়ালে বিমানটি থাকায় কেউ দেখতে পায় নি কিন্তু মিনহাজের বার্তা শুনতে পাওয়া যেত। রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার কে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার চেষ্টা করেন।
প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেন। রাশেদ চাইছিলেন, মতিউর রহমানের বিমান ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা সফল হওয়ার চেয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত করা ভালো। এ সময় রাশেদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে একসময় রাশেদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকায় তিনি শহীদ হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। ২০ই আগস্ট,১৯৭১ এ মতিউর রহমান শহীদ হন।
বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়ার কারণ:
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার সাহসিকতা ও নিজের পরিকল্পনায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করেছেন নিজের পরিবার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সমাধিস্থল:
পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মৃত্যুদেহ করাচির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে সমাহিত করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ২০০৬ সালে মতিউরের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। অতঃপর তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সম্মাননা:
যশোরে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি নির্মান করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে। বিমান বাহিনী তার নামে একটি ট্রফিও চালু রেখেছে। স্মৃতি রক্ষার জন্য বিমান বাহিনী কর্তৃক সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে একটি করে ট্রফি দেওয়ার প্রচলন ও করেন। মতিউর রহমানকে নিয়ে টিভির পর্দায়ও ড্রামা নির্মান করা হয় ২০০২ সালে। তার জীবনি নিয়ে ২০০৭ সালে অস্তিত্বে আমার দেশ চলচ্চিত্র নির্মান করা হয়।