ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর জীবনী
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য এবং পৃথিবীর বুক থেকে সকল অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্যায়, অসত্য, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যাভিচার, শিরক, কুফর, কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক নবুয়্যতের দরজাকে বন্ধ করে দিয়েছেন। তার পরে আর কোন নবী বা রাসূলের আবির্ভাব ঘটবে না। তবে একথা অসত্য নয় যে, প্রত্যেক যুগেই পথহারা মানুষদের সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্যে ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ এক বা একাধিক মনীষীর আবির্ভাব ঘটবে এই ধরাতে। তাদের চরিত্র ও স্বভাব হবে মার্জিত, আকর্ষণীয় ও অনুপম। তারা দুনিয়াকে ভোগ বিলাসের লক্ষ্য বস্তু মনে করবেন না। তাদের চরিত্র, স্বভাব ও সাধারণ জীবন যাত্রা দেখে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য ন্যায়ের পথে। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ছিলেন তাদেরই একজন।
ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর জীবনী
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল এ ইরানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ সাদী, মহাকবি ফেরদৌসী, আল্লামা হাফিজ, আল্লামা রুমী এর মতো বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম মনীষীগণ। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর প্রকৃত নাম আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালী। কিন্তু তিনি ইমাম গাজ্জালী নামেই খ্যাত। গাজ্জাল শব্দের অর্থ হচ্ছে সূতা কাঁটা। এটা তার বংশের উপাধি।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর পিতা ছিলেন দরিদ্র এবং শৈশবেই তিনি তার পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুতে তিনি নিদারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েন কিন্তু সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। তৎকালীন যুগের বিখ্যাত আলেম হযরত আহমদ ইবনবে মুহাম্মদ বারকানী এবং হযরত আবু নসর ইসমাইলের নিকট তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ও বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ছুটে যান নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। তৎকালীন যুগে নিশাপুর ছিল ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে সমৃদ্ধ। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সর্বপ্রথম ও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিজামিয়া মাদ্রাসা। সেখানে তিনি উক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (রঃ) এর নিকট ইসলামী দর্শন, আইন সহ বিবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। আল্লাহর স্বরূপ ও সৃষ্টির রহস্য তিনি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তার মতে আত্মা ও সৃষ্টির রহস্য এবং আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কে মীমাংসা করার বিষয় নয়, বরং এরূপ চেষ্টা করাও অন্যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও সৃষ্টির রহস্য অনুভূতির বিষয়। পরম সত্য ও অনন্তকে যুক্তি দিয়ে বোঝার কোন উপায় অবকাশ নেই।
ধর্ম ও দর্শনে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর ছিল প্রভূত জ্ঞান। ধর্ম ও যুক্তির নিজ নিজ বলয় তিনি নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না কিন্তু দেহ ধ্বংস হয়। আত্মা মৃত্যুর পর জীবিত থাকে। হৃদপিণ্ডের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নেই। হৃদপিণ্ড একটি মাংসপিণ্ড মাত্র।’
অংক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে ছিল ইমাম গাজ্জালীর বিশেষ আগ্রহ। নক্ষত্রাদির গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ২টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রায় চার সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার অধিকাংশ গ্রন্থই ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করে। ইমাম গাজ্জালী প্রণীত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১। ইহিল-উল-উলমুদ দীন
২। কিমিয়াতে সা’দাত – এ গ্রন্থটি ক্লড ফ্লিড The Alchemy of happiness নাম দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এ গ্রন্থটি ‘সৌভাগ্যের পরশমণি’ নামে বাংলা ভাষাতেও অনূদিত করা হয়েছে।
৩। কিতাবুল মনফিদলিন আদ দালাল- এ গ্রন্থটি The liberation Fromerror নাম দিয়ে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
৪। কিতাবুল তাকাফাতুল কালাসিফা- এ গ্রন্থটি ক্লড ফিল্ড The Internal Contradiction of Philosophy নাম দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
৫। মিশকাতুল আনোয়ার
৬। ইয়াক্কুত্তাবলিগ
৭। মনখুল
উপরে উল্লেখিত সব গ্রন্থ সমগ্র ইউরোপে সমাদ্রিত হয় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ মহামনীষী ইসলামী জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইসলামের এক নব জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ১১১১ সালে ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন- ইমাম বুখারী (র) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আরও পড়ুন- ইমাম আবু হানিফার সংক্ষিপ্ত জীবনী
আরও পড়ুন- আল ফারাবী কে ছিলেন? আল ফারাবীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আরও পড়ুন- ইবনে সিনা কে ছিলেন? চিকিৎসা শাস্ত্রে ইবনে সিনার অবদান