ত্যাগের উৎসব ঈদুল আযহার ইতিহাস ও তাৎপর্য

ঈদুল আযহা মূলত আরবি শব্দ, যার বাংলা মানে হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় দুটি উৎসবের অন্যতম এটি। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো আমিত্ব পরিহার করা, নিজের মনের পশুকে কুরবানি দেয়া।

ঈদুল আযহার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ঈদুল আযহার দিনে মুসলিমগণ ফজরের নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করেন এবং স্ব স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী হালাল পশু তথা উট, দুম্বা, ভেড়া, গরু ও ছাগল কোরবানি করেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বর্ণণা অনুযায়ী, হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তার স্বীয় বালক পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কুরবানীর করতে উদ্যত হন। কিন্তু আল্লাহপাক অলৌকিকভাবে ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) এর মাধ্যমে ইসমাইলের জায়গায় একটি দুম্বা (ভেড়া সদৃশ জন্তু) রেখে দেন এবং তা কুরবানী হয়ে যায়।

এই ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য মুসলমানগণ তৎকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর পশু কুরবানির মাধ্যমে নিজেদের ত্যাগ স্বীকার করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকে। হিজরি সাল অনুযায়ী প্রতি বছর জিলহজ্ব মাসের নবম, দশম, এবং এগারোতম চন্দ্ররাতে (দশ, এগারো, বারো তারিখ পর্যন্ত) ঈদুল আযহা পালিত হয়ে থাকে। বছরের অনুযায়ী জ্বিলকদ মাসের সত্তর দিন পর ঈদুল আজহা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইসলাম ধর্ম মতে যার যাকাত দেওয়ার সামর্থ্য আছে তার ওপর হালাল জন্তু কুরবানী করা ওয়াজিব। যার অর্থ অবশ্য পালনীয়। কুরবানী ঈদের নামাজ আদায়ের আগে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ।

ঈদুল আযহার তাৎপর্য

ঈদুল আযহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পবিত্র কুরআনুল কারীমে ‘কোরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যার সমার্থক অর্থ দাঁড়ায় কুরবানী। হাদিস শরীফেও একে ‘উযহিয়াহ’ ও ‘যাহিয়া’ বলে উল্লেখ করে বর্ণণা দেওয়া হয়েছে।আরবি কুরবান শব্দের ফারসি শব্দ যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘নৈকট্য লাভ’। এ দিনে পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের খারাপ দিকগুলোরও কুরবানি দিয়ে অর্থাৎ বর্জন করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করাই প্রত্যেক মুসলমানের মূল উদ্দেশ্য।

আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّنْ شَعَائِرِ اللهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌ-  “আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে” (সূরা হজ্জ ৩৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ- ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (সূরা-ছাফফাত ১০৭-১০৮)।

এছাড়াও আরেক নির্দেশনায় আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ  ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (সূরা আল কাওছার ২)।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرِبَنَّ مُصَلاَّنَا  ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’

ঈদুল আযহা ইবরাহীম (আঃ), বিবি হাজেরা ও ইসমাঈল (আঃ) এর পরম ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত উৎসব। ইবরাহীমকে (আঃ) কুরআনে মুসলিম জাতির পিতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিবারটি বিশ্ব মুসলিমের জন্য ত্যাগের অন্যতম উদাহরণ। তাই ঈদুল আযহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি ইবরাহীমী সুন্নাত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। কুরবানীর স্মৃতি বহমানকারী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ। যা প্রতি বছরই আমাদেরকে তাওহিদের প্রেরণা দান করে।আমরা অনুভব করি বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। ঈদের উৎসব একটি সামাজিক উৎসব, সমষ্টিগতভাবে আনন্দের অধিকার পালনের উৎসব। এ উৎসবের একটি অঙ্গ হচ্ছে কুরবানী।

কুরবানী হলো আত্বশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম

কুরবানী সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এ রীতির প্রবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহই একমাত্র বিধাতা প্রতি মুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ আশা করে। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত করা এবং কুরবানী হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক।

কুরবানীর ঈদ প্রসঙ্গে সাধারণত একটি প্রশ্ন এসে যায়। আমরা কি শুধু কুরবানীর সময়েই গরীব-দুঃখী মানুষ আহার করানোর কথা ভাবব? আর বছরের বাকি দিনগুলো কি তাদেরকে ভুলে থাকব? অবশ্যই না! আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই কুরবানীর উৎসব। সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় নিজেদের সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগ করতে হবে। এই ত্যাগের মনোভাব যদি গড়ে ওঠে তবে বুঝতে হবে, কুরবানীর ঈদ স্বার্থক হয়েছে, কুরবানী স্বার্থক হয়েছে। নয়ত এটি নামেমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে সব সময়। আল-কুরআনে আল্লাহ বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল মালের কিছু অংশ এবং আমি যা তোমাদের জন্য যমীন হ’তে বের করেছি তার অংশ ব্যয় কর’ ( সূরা আল বাক্বারাহ ২৬৭)। আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানবতার সেবায় ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র মানুষের সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সকল বিত্তশালী লোকদের এগিয়ে আসতে হবে। সারা বছর, সারা জীবন সাধ্যমত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের কথা বিবেচনা করে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। চিত্ত ও বিত্ত এই দুটি জিনিসের মিলন ঘটানোর জন্যই আল্লাহ পবিত্র কুরআনুল কারীমে বারংবার মানুষদের আহ্বান করেছেন।

আরও পড়ুন- ঈদ উল ফিতর অর্থ কি? কীভাবে শুরু হয়েছিল?

আরও পড়ুন- ছানা দোয়ার বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ || নামাজে ছানা কখন পড়তে হয়?

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *