বিশ্বকাপে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোঃ সম্ভাবনার শুরু থেকে হতাশার শেষ
২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবার যখন এসেছিলেন তখন মাদেইরার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছিলেন নিছকই এক সম্ভাবনাময় তরুণ। দলে লুইস ফিগো আর ডেকোর মত অভিজ্ঞ দুই সেনানীর সাথে বিশ্বকাপে পর্তুগিজ স্বপ্নের সারথী ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ২০০৪ সালে নিজ দেশে হওয়া ইউরোতেই নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া এই তরুণ জার্মানিতে পা রেখেছিলেন একরাশ স্বপ্ন নিয়ে। সেবার শেষ চারে যাত্রা থামলেও রোনালদো এরপর থেকে উড়েছেন পর্তুগালের যুবরাজ হয়ে। খেলেছেন মোট ৫টি বিশ্বকাপে। তবে অসীম সম্ভাবনায় শুরু করা সেই যাত্রার শেষটা সুন্দর হয়নি। ৫ বিশ্বকাপে রোনালদোর সেরা সাফল্য হয়ে আছে সেই ২০০৬ সালের আসরটাই।
বিশ্বকাপ ২০০৬: মাদেইরা আর ম্যানচেস্টারের সম্ভাবনাময় তরুণ
রোনালদোকে বিশ্ব চিনতে শুরু করেছিলো আরও দুই বছর আগে। ২০০৪ ইউরোতেই সবার নজরে আসেন রোনালদো। নিজ দেশের মাটিতে গ্রিক রূপকথায় সেবার ইউরো জেতা হয়নি পর্তুগালের। তবু একরাশ আশা নিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে পর্তুগাল। ২০০২ সালে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানো কোচ লুই ফিলিপ স্কোলারি ছিলেন পর্তুগালের কোচ। রোনালদোর বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় ১৭ নং জার্সিতে। অ্যাঙ্গোলার সাথে ম্যাচটা অবশ্য ভালো যায়নি তার। ২৬ মিনিটে হলুদ কার্ড আর কস্তিনহার বদলিতে মাঠ ছাড়া।
বিশ্বকাপে রোনালদো নিজের প্রথম গোল পেয়েছিলেন অবশ্য ঠিক তার পরের ম্যাচেই। ইরানের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন। এই গোলের মাধ্যমে মাত্র ২১ বছর বয়সে বিশ্বকাপে পর্তুগালের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হন রোনালদো। আর গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে মাঠেই নামা হয়নি তার।
রাউন্ড অভ সিক্সটিনে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে নেমেছিলেন তরুণ রোনালদো। যদিও ‘ব্যাটেল অভ নুরেমবার্গ’ খ্যাত সেই ম্যাচে ৩৪ মিনিটেই ইনজুরির জন্য মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের সাথে পেনাল্টি শ্যুটআউটে গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। সেমিফাইনাল আর তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে মাঠে নামলেও তেমন কিছুই করা হয়নি রোনালদোর। পর্তুগাল বিশ্বকাপ শেষ করে ৪র্থ হয়ে।
বিশ্বকাপ ২০১০: পর্তুগাল অধিনায়ক CR7
আফ্রিকার বুকে প্রথম বিশ্বকাপ। পর্তুগাল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা লুইস ফিগোর অবসর। ম্যানচেস্টারের বেকহ্যামের পর রোনালদোই পেয়েছিলেন আইকনিক সাত নং জার্সি। ২০০৯ সালে ইতিহাস গড়ে গায়ে জড়ালেন রিয়াল মাদ্রিদের রাজকীয় সাদা জার্সি। রোনালদো ততদিনে বিশ্বের সেরা ফুটবলারের তকমাও পেয়েছেন। রাউলকে সরিয়ে পেয়েছেন রিয়ালের সাত নং জার্সিটাও। ফিগোর পর পর্তুগালেও সাত নাম্বার জার্সিটা গেলো রোনালদোর কাছে। সেই সাথে অধিনায়কের দায়িত্বটাও। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ততদিনে মহাতারকা CR7।
তবে বিশ্বকাপে কেন যেন জ্বলে উঠতে পারলেন না পর্তুগালের অধিনায়ক। কার্লোস কুইরোজের অধীনে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আইভরিকোস্টের সাথে ড্র করলো পর্তুগাল। পুরো ম্যাচে নিষ্প্রভ রোনালদো। পরের ম্যাচে দুর্বল উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে অবশ্য দর্শনীয় গোল করলেন পর্তুগিজ অধিনায়ক। ম্যাচের প্রায় শেষ পর্যায়ে ৮৭ মিনিটে করা গোলটাই ২০১০ বিশ্বকাপে রোনালদোর একমাত্র গোল। গ্রুপের শেষ ম্যাচে হট ফেভারিট ব্রাজিলের সাথে ড্র করার পর রাউন্ড অভ সিক্সটিনে স্পেনের কাছে হার। দুই ম্যাচেই দলের মতো ব্যর্থ রোনালদো নিজেও।
বিশ্বকাপ ২০১৪: পরিণত রোনালদোর হতাশার বিশ্বকাপ
ইউরোপ আর আফ্রিকার পর বিশ্বকাপের পরের গন্তব্য ফুটবলের পূণ্যভূমি লাতিন আমেরিকায়। শৈল্পিক ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে বড় আশা নিয়ে হাজির পর্তুগাল। ধুঁকতে থাকা দলকে বাছাইপর্বের শেষে একাই টেনেছিলেন রোনালদো। সুইডেনের সাথে তার হ্যাটট্রিকে ভর করেই ব্রাজিলের টিকেট ধরেছিলো পর্তুগাল। কেবল আগের বছরেই জিতেছেন ব্যালন ডি’অর পুরষ্কার।
২০১৪ বিশ্বকাপে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচেই থমাস মুলারের হ্যাটট্রিক। দ্বিতীয় ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আবারও হারের মুখে পর্তুগাল। ম্যাচের শেষ মিনিটে রোনালদোর পাস থেকে গোল করে দলকে বাঁচান সিবাস্তিয়ান ভারেলো।
শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ ঘানা। ম্যাচের শুরুতে গোল পেলেও লিড ধরে রাখতে ব্যর্থ পর্তুগাল। রোনালদো গোল করলেন ৮০ মিনিটে। ম্যাচ জিতেও গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ ইউরোপের ব্রাজিল খ্যাত পর্তুগিজরা। ৩ বিশ্বকাপ শেষে রোনালদোর গোল মাত্র ৩। জাতীয় দলে সমসাময়িক গ্রেট মেসির মতোই ব্যর্থ কিনা রোনালদো… সেই বিতর্কও তুঙ্গে।
বিশ্বকাপ ২০১৮: কিংবদন্তী রোনালদোর হ্যাটট্রিক কীর্তি
দুই বছর আগেই নিজের জাতীয় দলের ব্যর্থতার ইতি ঘটিয়েছেন রোনালদো। চার গোল করে দলকে ইউরোপ সেরার মুকুট পরাতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন CR7। নামের পাশে ততদিনে ৫ ব্যালন ডি’ অর। মাত্রই জিতে এসেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ৩৩ বছরে রোনালদো নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।
রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে স্পেনের বিপক্ষে মাঠে নামলেন রোনালদো। বিশ্বকে আরো একবার দেখালেন নিজের সক্ষমতা। চার মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোলের পর ২৬ মিনিটে দ্বিতীয়বার স্কোরশিটে নিজের নাম তুললেন CR7। পর্তুগাল যখন আরো একবার হারের মুখে তখনই ৮৮ মিনিটে দারুণ ফ্রিকিকে গোল করলেন পর্তুগিজ অধিনায়ক। বিশ্বকাপে তো বটেই, নিজের ক্যারিয়ারেই অন্যতম সেরা পারফর্ম সেদিন করেছিলেন এই মহাতারকা। সেই সাথে সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের রেকর্ডও নিজের করে নিয়েছেন তিনি।
পরের ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো একমাত্র গোলটাও করেছিলেন রোনালদো। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ইরানের সাথে ১-১ গোলে ড্র করলো দল। পরের রাউন্ডে পর্তুগাল।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরে উরুগুয়ের কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় ইউরোপ সেরাদের। আরও একবার নকআউট পর্বে গোল বা অ্যাসিস্ট ছাড়াই বিশ্বকাপ যাত্রার ইতি ঘটালেন রোনালদো। ৪ বিশ্বকাপ শেষে তার গোল সাত।
বিশ্বকাপ ২০২২: চোখের জলে কিংবদন্তীর বিদায়
মাদেইরার কিশোর রোনালদো এখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। মাঝে স্পেনের মাদ্রিদ আর ইতালির তুরিন ঘুরে আবার ফিরেছেন পুরাতন ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। তবে পড়ন্ত সময়ে রোনালদো কিঞ্চিৎ টালমাটাল। বিশ্বকাপের আগে ক্লাবে নিজের অবস্থান হারালেন, জড়ালেন একাধিক বিতর্কে। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই ক্লাবের সাথে নিজের দূরত্ব তুলে ধরে সাক্ষাৎকার দিলেন। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই ম্যান ইউনাইটেডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন রোনালদোর।
বিক্ষিপ্ত সেই রোনালদোর দেখাই যেনো মিললো বিশ্বকাপে। ঘানার সাথে পেনাল্টিতে প্রথম ম্যাচে গোল অবশ্য পেয়েছেন তিনি। এই গোলের পর সঙ্গী হলো আরেকটি রেকর্ড। পাঁচটি ভিন্ন বিশ্বকাপে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
কিন্তু ওইটুকুই। গ্রুপের পরের দুই ম্যাচ বেঞ্চ থেকে শুরু করলেন পর্তুগালের নিয়মিত মুখ। ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর আর কখনোই এমন দৃশ্য দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। পর্তুগাল অবশ্য গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে রোনালদোর বদলে ম্যাচ শুরু করা গন্সালো রামোস করলেন হ্যাটট্রিক। দলে সিআরসেভেনের জায়গা আরেকটু নড়বড়ে অবস্থায়।
কোয়ার্টার ফাইনালের আগে গুঞ্জন রোনালদোকে ছাড়াই মাঠে নামতে চায় পর্তুগাল। হলোও তাই। মরক্কোর সাথে ম্যাচটায় অবশ্য বদলি নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু ম্যাচে দলকে আর ফেরাতে পারেননি। নতুন এক রূপকথা লিখে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে শেষ চারে জায়গা করে নেয় মরক্কো। অশ্রুশিক্ত রোনালদো হয়ে উঠেন বিশ্বকাপে হতাশার নতুন পোস্টার।
সবমিলিয়ে রোনালদোর বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান
বিশ্বকাপ অংশগ্রহণঃ ৫
ম্যাচঃ ২২
গোল ৮
অ্যাসিস্ট দুই
সেরা সাফল্যঃ চতুর্থ স্থান (২০০৬ বিশ্বকাপ)।