বাংলাদেশে আঘাত হানা বিধ্বংসী যত ঘূর্ণিঝড়
নদী বিধৌত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে প্রাণঘাতি সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ”ঘূর্ণিঝড়” আমাদের দেশের অন্যতম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার কালো থাবায় বাংলাদেশ তার স্বাভাবিক গতিপথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। আজকে আমাদের আলোচনার উপজীব্য বিষয় বাংলাদেশে আঘাত হানা সেসব প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়।
বাংলাদেশে আঘাত হানা স্বাধীনতা-পূর্ব ঘূর্ণিঝড়ের ইতিবৃত্ত
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এর ঠিক দশ বছর পূর্বে ১৯৬০ সালের অক্টোবরে ঘন্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালী। ৫-৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস বয়ে যাওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এর এক বছর পর ১৯৬১ সালের ৯ মে আরেকটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। এদিন বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় প্রায় ১৬১ কিলোমিটার। আর এতে প্রাণ হারায় প্রায় ১১ হাজার মানুষ। ১৯৬২ সালের ২৬ অক্টোবর ফেনী জেলায় তীব্র এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৬৩ সালটি ভুলে থাকতে পছন্দ করেন উপকূলীয় অঞ্চল মহেশখালী, হাতিয়া, কক্সবাজার, নোয়াখালী, সন্দীপ ও কুতুবদিয়ার মানুষেরা। ১৯৬৩ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এই অঞ্চলে প্রাণহানি ঘটে ১১ হাজার ৫০০ নিরীহ লোকের। ১৯৬৪ সালটি স্বস্তিতে কাটালেও ১৯৬৫ সালের মে মাসে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জের প্রায় ১৯ হাজার ৫০০ মানুষ প্রাণ হারায়। ওই বছরের ডিসেম্বরেই কক্সবাজারে মৃত্যু হয় আরো ৮৮৩ জন নিরীহ মানুষের। ১৯৬৬ সালে সন্দীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণ হারায় ৮৫০ জন। এরপর ১৯৭০ সালের ১৩ই নভেম্বর স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায় ‘গ্রেট ভোলা’ নামের শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড়। এ সময়ে বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় প্রায় ২২২ কিলোমিটার। এতে প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং ১২ লাখ মানুষের বসতভিটা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়সমূহ
নভেম্বর ১৯৮৮, ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। এ সময়ে বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় ১৬২ কিলোমিটার। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষ।শতাব্দীর প্রচন্ডতম ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যা পাওয়া ও ১৯৯১ সালে ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি লাভ করা প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিলো ঘন্টায় ২২৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এক কোটির বেশি মানুষের ক্ষতি সাধনকারী এই ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার।
২০০৭ সালের ‘সিডর’
২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন। রেড ক্রিসেন্ট এর তথ্যমতে এই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে সৃষ্ট এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিলো প্রায় ২৬০-৩০৫ কিলোমিটার। সিডর খুলনা ও বরিশাল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। এতে ৩১ জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বলা হয় যে, সিডর উপকূলীয় লোকদেরকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। এমনকি সুন্দরবনের নিরীহ প্রাণীগুলোও সিডরের নির্মমতা থেকে রক্ষা পায়নি।
২০০৯ সালের ‘আইলা’
২০০৯ সালের ২৫মে খুলনা উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। এতে প্রায় ১৯৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়।
২০১৩ সালের ‘মহাসেন’
ঘূর্ণিঝড় মহাসেন ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ে ১৭ জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০১৫ সালের ‘কোমেন’
৩০ জুলাই, ২০১৫ সালে কোমেন নামক ঘূর্ণিঝড় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘাত হানে।
২০১৬ সালের ‘রোয়ানু’
২১ মে, ২০১৬ উপকূল অঞ্চলে আঘাত হানে ছোট আকৃতির ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়।
এছাড়াও ২০১৭ সালের ৩০ মে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। এর প্রভাবে অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। জমির ফসল এবং লবণ চাষীদের লবণও নষ্ট হয়ে যায়। হতদরিদ্র এ সকল মানুষের জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আর এতে ২ জন নারীসহ ৩ জন মৃত্যুবরণ করে।
২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণীর’ আঘাতে ৯ জনের মৃত্যু হয়। একই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে প্রাণ হারায় ২৪ জন।
২০২০ সালের ২১ মে, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ বাংলাদেশের ৮ জেলায় আঘাত হানলে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া আর্থিক ক্ষতি তো রয়েছেই।
২০২১ সালের ২৬ মে ‘ইয়াশ’ নামক তুলনামূলক দুর্বল এক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় আঘাত হানে। এর ফলে আক্রান্ত জেলাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর মাঝারি শক্তির ঘূর্ণিঝড় ‘সিএ্রাং’ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার গতির এ ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ও দেয়াল চাপায় ৭ জনের প্রাণহানি ঘটে।
আরও পড়ুন- ঘূর্ণিঝড় সিডর নিয়ে যত প্রশ্ন