জেরুজালেমের ইতিহাসঃ এক ভূখন্ডে জন্ম তিন ধর্মের

ইসলাম, খ্রিষ্ট এবং ইহুদী ধর্মের জন্মস্থান জেরুজালেম। একখণ্ড ভূমিতে জন্ম হয়েছে এই তিন ধর্মের। ১০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে দাউদ (আঃ) সর্বপ্রথম জেরুজালেম জয় করেন। এরপর তার পুত্র সুলাইমান (আঃ) প্রায় ৪০ বছর পরে এখানে মসজিদ তৈরি করেন।

খ্রিষ্টানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা এই জেরুজালেম। কারণ যিশুর জন্ম এই জেরুজালেম শহরেই। তিনি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এখানেই ধর্ম প্রচার করেন। তার জীবনের শেষ অধ্যায়ও এই শহরেই রচিত হয়। যিশুর মৃত্যু হয় ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে।

ইহুদীদের জন্যেও জেরুজালেম শহর গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদীদের প্রথম প্রার্থনাস্থল জেরুজালেম শহরেই অবস্থিত। ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু অবাক করা এবং অজানা ঘটনা জড়িত রয়েছে জেরুজালেমের সাথে। জানা যায়, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর জীবদ্দশায় এক রাতে মক্কা থেকে জেরুজালেম এবং জেরুজালেম থেকে আসমান পর্যন্ত অলৌকিকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তার এই ভ্রমণের নাম আমরা মিরাজ নামে জানি। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর প্রচারিত বাণী দ্রুত মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার এই বানী গ্রহণ করে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে মানুষ। কিন্তু তখনকার বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য দক্ষিণ সীমান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়া এই ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। যদিও তাতে বিন্দুমাত্র কোন ক্ষতির মুখোমুখি হয়নি। তাবুক অভিজানে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর নেতৃত্বে প্রায় ৩০০০০ সৈনিক বাইজেন্টাইন সীমানা অভিমুখেযাত্রা করেন।

জেরুজালেমের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু তথ্য জানা যায়। কিছু কিছু গবেষকদের দাবী প্রাচীন ব্রোঞ্চ যুগ থেকেই এখানে মানুষের বসবাস। আর সেটা ঠিক কত সাল থেকে তা পুরোপুরি না জানা গেলেও ধারণা করা হয় যে ৩৫০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকেই। দাউদ (আঃ) জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করার পর ৫৮৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ব্যবিলনীয়রা জেরুজালেম অধিকৃত করেন। এক সময় পার্শিয়ান রাজা সাইরাস ইহুদীদের জেরুজালেমে ফেরত আসতে দেন এবং তারা আবার ধর্মীয় স্থাপনা স্থাপন করেন।

এগারো শতাব্দীতে ইউরোপিয়ান শাসকেরা ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ে জেরুলামকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সৈন্যরা জেরুজালেমের কাছাকাছি চলে আসে। তখন সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় খ্রিষ্টান গির্জার প্রধান যাজক সোফ্রোনিয়াস। খালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ এবং আমর ইবনে আল-আস এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী শহর পরিবেষ্টন করা শুরু করলেও উমর নিজে এসে আত্মসমর্পণ না করলে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান সোফ্রোনিয়াস। এই খবর পেয়ে ইবন আল-খাত্তাব একা একা একটি গাধা এবং তার এক চাকরকে নিয়ে মদিনা ছেড়ে জেরুজালেমের পথে যাত্রা করেন। জেরুজালেমে সোফ্রোনিয়াস তাকে স্বাগত জানান। তখনকার প্রচণ্ড ক্ষমতাধারী উমরকে সাধারণ পোশাকে দেখে ভৃত্য এবং মালিকের মাঝে আলাদা করা যাচ্ছিল না। এ অবস্থা দেখে গির্জার যাজক সোফ্রোনিয়াস খুবই অবাক হয়ে যান। তিনি উমরকে পবিত্র সমাধি, গির্জা সহ পুরো শহর ঘুরিয়ে আনেন। জানা যায়, নামাজের সময় হলে গির্জার সেই যাজক উমরকে গির্জাতেই নামাজ পড়ার কথা বললে উমর তা প্রত্যাখান করেন! তিনি জানান, তিনি এই মুহূর্তে এখানে নামাজ পড়লে মুসলিমরা গির্জাকে মসজিদে পরবর্তীতে রূপান্তরিত করতে অজুহাত দেখাবেন। যার ফলে খ্রিষ্টান সমাজ তাদের এই পবিত্র স্থান থেকে বঞ্চিত করবে। বরং উমর সেখানে একটি মসজিদ নির্মিত করেন যার নাম হয়, মসজিদে উমর।

১৯১৭ সালে এক শীতার্ত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ড অ্যালেনবি এসে পৌঁছান জেরুজালেমে। তখন সদ্য অটোমান-তুর্কিদের হাত থেকে তাদের শহর জিতে নিয়েছিলো। এ সময় তিনি জেরুজালেমে প্রবেশ করেন পায়ে হেঁটে। জাফা গেট দিয়ে এই শহরে প্রবেশ করেন, কোন প্রকার জয়োল্লাস ছাড়াই। তখন জেরুজালেম পবিত্র স্থান হলেও রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ব্রিটিশরা এসেই জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আর এর পর পরই শুরু হয় নতুন এক সংঘর্ষের অধ্যায়। এই সংঘর্ষের একদিকে রয়েছে এই শহরের ফিলিস্তানিরা অন্যদিকে রয়েছে ইহুদীরা। ইউরোপে তখন সদ্য ইহুদী বিদ্বেষ শুরু হয়েছে। এই বিদ্বেষের পর বিভিন্ন কারনে ইহুদীরা ভিড় জমান ফিলিস্তানে, এবং বেশীরভাগই জেরুজালেমে। ফেরাউনদের হাতে বন্দী ইহুদীদের বাঁচিয়ে মুসা আঃ এই ভূমিতেই নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।

বেলফোর নামের এক ঘোষণাপত্র ইহুদীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বেলফোর ঘোষণাপত্র হচ্ছে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এক চুক্তি যা প্রতিষ্ঠিত করে যুক্তরাজ্য। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরথার বেলফোর এক চিঠিতে ব্রিটিশ ইহুদী নেতা লিওনেল ওয়াল্টারকে এই প্রতিশ্রুতি দেন। বেলফোর ঘোষণা ছিল একটি লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক প্রতিশ্রুতি। ব্রিটিশ সরকার হয়ত আন্দাজ করতে পারেনি তাদের এই বেলফোর প্রতিশ্রুতির জন্য লজ্জায় নিজেদের মাথা নত করা উচিত।

জেরুজালেম শহরটি অন্যান্য কারণে আলোচিত হলেও এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী ধর্মীয় দিক থেকেই। তিনটি প্রধান ধর্মের কাছেই জেরুজালেম শহরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্মমতে, তাদের অন্যতম পবিত্রতম স্থান এই জেরুজালেম শহর। মুসলিমদের ধর্মীয় স্থান আল-আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর সাথে দেখা করেন।

ইহুদীরা মনে করেন জেরুজালেমই তাদের আদি নিবাস। ইহুদীদের অন্যতম প্রধান পবিত্রতম ভূমি টেম্পল মাউন্ট বা ঈশ্বরের ঘর, যা মুসলিমদের কাছে পরিচিত পবিত্র কুব্বাত আস-সাখরা নামে। টেম্পল মাউন্টেনকে ঘিরে থাকা ওয়েস্টার্ন ওয়াল ইহুদীদের কাছে পৃথিবীর ভিত্তিস্তর হিসেবে স্বীকৃত।

যিশুখ্রিস্টের বহু স্মৃতিবিজড়িত গির্জার কারণে খ্রিষ্ট ধর্মালম্বীদের কাছেও পবিত্রতার দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে জেরুজালেম। তাদের বিশ্বাস, জেরুজালেমের বেথেলহামে যিশুর জন্ম আর এই শহরে তাকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিলো।

জানা যায়, ১৮৪৮ সালে ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই ইসরায়েল জেরুজালেমের পশ্চিমাংশে দেশের সংসদ ভবন স্থাপন করে। মুসলিম এবং ফিলিস্তানিদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশে বিভিন্ন সময় বাঁধা প্রদান করে সহিংসতায় জড়িয়ে পরে ইসরায়েল। শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসে মাউন্ট টেম্পলে সহিংসতাকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের জন্য বায়তুল মুকদ্দাসে প্রবেশ বন্ধ রাখে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক চাপের কারণে প্রায় সতেরো দিন পরে এর প্রবেশদ্বার খুলে দিতে বাধ্য হয় ইসরায়েল।

তবে ফিলিস্তানিরা কোনোদিনই জেরুজালেমের দখল মেনে নেয়নি।  গত দশ বছরেও অনেক ইহুদীরা জেরুজালেমের অনেক জায়গায় বসতি স্থাপন করলেও এখানকার প্রায় বেশীরভাগ অধিবাসীই ফিলিস্তিনি।

জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্তটি বেশ পুরনো। ১৯৯৩ সালে হোয়াইট হাউজে বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। এর মাধ্যমে আইএলওকে স্বীকৃতি দেয় ইসরায়েল। আর এর পরেই পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে এই চুক্তিটি। সমস্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরপর ১৯৯৫, ১৯৯৮,২০০০ ও ২০০১ সালে ফিলিস্তানে ও ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বিল ক্লিনটন। ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ফিলিস্তান সফরে যান বিল ক্লিনটন। এরপর ডোনাল্ড ট্র্যাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। তিন ধর্মের তীর্থস্থান হিসেবে স্বীকৃত জেরুজালেমকে শুধু ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করায় ফিলিস্তানের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।

মার্কিন মিত্রদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, সৌদি আরব সহ পাকিস্তান ট্র্যাম্পের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন। অন্যদিকে ইরান, সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি দেশ তার এই সিদ্ধান্তে সমালোচনা করেন। ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের সঙ্গে এক ফোনালাপে আরব নেতারা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো ট্র্যাম্পের এই পদক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আর তার এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খমেনি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তের কারণ হলো তাদের অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতা। বিখ্যাত এই জেরুজালেম নিয়ে ইতিহাস মুখোমুখি হয়েছিলো এমন হাজারো সমালোচনা সহ বেশ কিছু ঘটনার।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *