নবাব সিরাজউদ্দৌলা
August 26, 2023
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি ১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। অল্প সময়েই তিনি রাজত্ব করছিলেন কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। নবাবের সমাপ্তির পরে বাংলা এবং পরবর্তীতে প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনা হয়। সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খানের কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে ক্ষমতা অর্জন করেন। রায়দূর্লভ ও সেনাপতি মিরজাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার কারনেই মুলত ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। রর্বাট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহন করে।এভাবেই বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭৩৩ সালে। সিরাজ ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দি খানের নাতি। আলীবর্দি খান যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন তখন তার তৃতীয় কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে সিরাজউদ্দৌলা জন্ম হয়েছিলো। এজন্য আলীবর্দি খান সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষ্মণ হিসেবে স্বকৃতি দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার নানার আদরের নাতি থাকায় খুব স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন।নবাব আলীবর্দি খানের স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়েই সিরাজ বড় হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পূর্বসূরি আলীবর্দি খান এবং উত্তরসূরি মীর জাফর। তার বংশধর উম্মে জোহরা। নবাবের পূর্ব নাম ছিলো (নবাব মনসুর উল-মুল্ক সিরাজউদ্দৌলা শাহ কুলি খান মির্জা মুহম্মদ হয়বত জঙ্গ বাহাদুর)পরবর্তীতে তার নাম হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তার ধর্ম ছিলো শিয়া ইসলাম। তার আনুগত্য সুবহা বাংলা শাখা ছিলো বাংলার। নবাব দুটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো ১|বর্গির হাঙ্গামা ২|পলাশীর যুদ্ধ। পলাশীর যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন।
১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল আলীবর্দি খান এর মৃত্যুর পরে চারদিকে শুরু হয় অরাজকতা, ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই এমন ষড়যন্ত্র ও অরাজকতা শুরু করার পরে কলকাতার দূর্গ সংস্কার শুরু করে। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ ইংরেজদের আস্রয়ে যেতে বলেন। এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিংহাসনে বসেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। এরপর থেকেই বাংলায় নবাবের শাসন শুরু হয় ।
সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসার সাথে সাথেই কলকাতায় ইংরেজদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে তাদেরকে দমন করার জন্য নবাব কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দূর্গ প্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের অনুমতি না নিয়ে এমন কাজ যেন না করে তার নির্দেশ দেন।
সিরাজের কথা না রেখেই তারা তাদের মতো কাজ করে যাচ্ছিল এমতাবস্থায় নবাব বুঝতে পারেন গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা উদ্ধত স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে। নবাব তখন ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ন করার জন্য আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি মতিঝিল প্রসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেন। নবাব কাশিমবাজারের উদ্দেশ্য রওয়া হলে ২৭ মে তার সেনাবাহিনী কাশিমবাজার দূর্গ অবরোধ করেন। তিনি কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে দরবারে হাজির করেন এবং নবাবের নির্দেশ যথাযথভাবে পালনের জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বলেন। ওয়াটসন এই অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য হয় এবং এটা যথযথভাবে পালনও করতে থাকে। একটু একটু করে নবাব সব গুছিয়ে আনার চেষ্টা করতেছিলো। এমন করেই নবাবের সিংহাসনে বসে প্রত্যকটা কাজ সম্পন্ন করছিলেন।
ঐ বছররেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন এবং তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পরে ২০ জুন নবাব কলকাতার দূর্গ নিজের করে নেন। দূর্গ দখল করার পরেই তিনি দরবারে উপনিবেশ করে উমিচাঁদকে ও কৃষ্ণবল্লভকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর মানিকচাঁদের হাতে দূর্গের সমস্ত কিছু বুঝিয়ে নবাব নিজে রাজধানিতে ফিরে আসেন। ১২ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিজ রাজধানিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
দিল্লির বাদশা পূর্নিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবি সনদ পাঠালেন। সব ধরনের গোলাগোল শান্ত হওয়ার পরেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার সেনপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করলেন। নবাবের আদেশে মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দী করা হয়। স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা সবাই নবাবেকে ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে সিংহাসনচুত্য করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনকে বলে যে নবাব কিছুদিনের মধ্যে ই ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোসনা করবেন এবং এজন্য ই তিনি পলাশিতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এই কাহিনি জানার পরে তার অর্ধেক সৈন্যকে লুকিয়ে রেখে বাকি অর্ধেক নিয়ে তিনি কলকাতায় রওনা হলেন এবং নবাবকে পত্র লিখলেন,
” আমার সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশীতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন?”
এমন পত্র হাতে পেয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি উঠিয়ে মুর্শিদাবাদে চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছেই গোপন সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতায় এই খসড়া সন্ধি নিয়ে আলোচনা হলো। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য গোপন সন্ধি তার কাছে পাঠানো হয় কিন্তু গুপ্ত বৈঠক আর গোপন থাকলো নাহ। এদিকে গোপন বৈঠকের কথা জেনে গেলেন সিরাজউদ্দৌলা এবং সাথে সাথে মীরজাফরকে বন্ধী করার ব্যবস্থা নিয়ে নিলেন। ওয়াটসন সব জানতে পেরে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানকার দূর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে বাকিদের ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন। কলকাতা থেকে মুর্শিবাদের পথে হুগলি,কাটোয়ার দূর্গ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও তাদের কে কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করলেন না তখনই নবাব বুঝে গেলেন এর মধ্যে কোন ষড়যন্ত্র আছে।
পরবর্তীতে বিদ্রোহের আভাস পেয়ে নবাব মীরজাফরকে বন্ধী না করে তাকে শপথ করালেন যে তার একবিন্দু রক্ত থাকাতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন হতে যেন না দেয়। গৃহবিবাদের মিমাংশা শেষ করে তিনি মীরজাফর, ইয়ার লতিফ,রায়দুর্লভ, মোহনলাল ও সেনাপতিদের সৈন চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।
২৩ জুন সকলে মিলে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়। ইংরেজরা লক্ষণবাগ নামক আমবাগানে সৈনদের সমাবেশ করালো। বেলা ৮:০০ টার দিকে মীরমদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমন করেন। তার প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে সবাই আমবাগানে আশ্রয়ে চলে যান। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হলেন। মীরমদন ধীরে ধীরে তার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন কিন্তু মিরজাফর রায়দুর্লভ ইয়ার লতিফ সৈন্য সমাবেশ করিয়ে সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সৈন্যদের সার্পোট পেলে হয়তো মীরমদন ইংরেজদের পরাজিত করতে পারতেন। দুপুরের দিকে বৃষ্টি এলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার গোলা বারুদ ভিজে যায় তবুও মীরমদন ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন এবং একটা সময় মীরমদন মৃত্যুবরন করেন। মীরমদনের পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। তিনি যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমনের পক্ষপাতর হলেন। ইতিমধ্যে মীরজাফর আবারও নবাবের বিশ্বাসঘাতকতা করলেন এবং সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। এমন সুযোগ পেয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমন করে এবং যুদ্ধ বিকাল ৫:০০ টায় শেষ হয়ে যায়। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপিয়ান ও ১৬ জন দেশীয় সৈনিক নিহত হয়। এ অবস্থা দেখে নবাব ২ হাজার সৈন নিয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে আসেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্য নবাবকে কেউ সাহায্য করেনি। এরপর তিনি সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দা মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেন। তার আশা ছিলো সে পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাস এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়নের কাছ থেকে সৈন্য নিয়ে ফরাসি সৈনিকদের সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।
মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তার নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মীর জাফরের সৈন্যবাহিনীকে খবর দেয়।এ সম্পর্কে ভিন্ন আরেকটি মত আছে যে এক ফকির এখানে নবাব কে দেখে চিনে ফেলে। উক্ত ফকির ইতঃপূর্বে নবাব কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে তার এক কান হারিয়েছিল। সেই ফকির নবাবের খবর জানিয়ে দেয়। তারা এসে সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) মীরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।