পরিবার পরিকল্পনা কি? পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব

পরিবার পরিকল্পনা কি?

পরিবার পরিকল্পনা হল সঠিক সময় সন্তান নেবার পরিকল্পনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য পদ্ধতির যথাযত প্রয়োগ নিশ্চিতকরন। অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে যৌন শিক্ষা, যৌন সংক্রামকসমুহের নির্গমন প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা। পরিবার পরিকল্পনাকে অনেক সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণের সমার্থক হিসেবে চিহ্ণিত করা হয় যদিও পরিবার পরিকল্পনার পরিধি আরও বিশদ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, পরিবার পরিকল্পনাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ” ব্যক্তি এবং দম্পতিদের তাদের পছন্দসই সন্তানের প্রত্যাশা ও অর্জন করার ক্ষমতা এবং তাদের জন্মের ব্যবধান এবং সময়।

পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্বঃ

একটি সুস্থ ,সবল ও সুখী পরিবার সবার প্রত্যাশা । আর এজন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা । বিয়ের পর কখন প্রথম সন্তান নেবেন, পরবর্তী সন্তান আবার কবে নেবেন, কয়টি সন্তান নেবেন এসব বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে আলাপ করে জন্মবিরতিকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ।

স্বামী – স্ত্রী পছন্দমত সময়ে এবং পছন্দমত সংখ্যায় সন্তান নিতে পারেন।

<>ঘন ঘন গর্ভধারনের ঝুঁকি কমায়, ফলে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি কমে।

<> মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

<>স্বামী ও স্ত্রীর শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক চাপ কমায়।

<> সন্তান সংখ্যা কম হলে সব সন্তানদের যথাযথ যত্ন নেয়া যায়, তাদের চাহিদা সমূহ সহজে পূরণ করা যায়।

<> সংসারে সুখ, শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ বাড়ায়।

<> জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি কমায়।

বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা প্রয়োজনীয়তাঃ

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত কোটি ১৫ লক্ষের মত যা ২০২২ সালে বেড়ে দাড়ায় ১৬,৫১,৫৮,৬১৬ জন । জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদের একটি প্রধান বড় সমস্যা । এ জন্যই ১৯৬৫ সালেপাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে পরিবার পরিকল্পনা শুরু করে।

পরিবার পরিকল্পনার উপকারিতাঃ

বাল্যবিবাহ
                                       বাল্যবিবাহ

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রচলিত আছে ফলে অল্প বয়সে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মা ও শিশু মৃত্যুর হার ইতিপূর্বে ভয়ঙ্কর রুপ নিয়েছিল। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশে বিগত বিশ বছরে শিশু মৃত্যুর হার ৬৩ শতাংশ কমিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই ২০০০ সাল থেকে শিশু মৃত্যু হ্রাসে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, যার প্রথম দিকের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ। শূন্য থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে এরইমধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্বীকৃতি দিয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিসেবার উন্নয়নের ফলেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এমনকি শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ ‘বার্ষিক গ্লোবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে ভুটানের শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতের ৫৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়েছে ৬৩ শতাংশ। এ সকল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার উপকারিতা কতটা সুদুরপ্রসারি ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্বঃ

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
                                জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ

পরিবার পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সন্তান লাভ, লালন-পালন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা এবং তাদের সামগ্রিক কল্যাণে সহায়তাদান । বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে স্বীকৃত আদর্শ পদ্ধতি হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা।

বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা। বাংলাদেশের সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশী হওয়ায় এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বিরাজমান অধিক জনসংখ্যা সমস্যার প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত দৃষ্টিকোন হতে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরা যায়। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম নিঃসন্দেহে একটি কল্যাণমূলক কর্মসূচী যা মূলত পরিবারকেন্দ্রিক। জনসংখ্যাবিদদের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বিষয়ে দু’টি ভিন্নমত রয়েছে-একটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং অপরটি হচ্ছে পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার সীমিত করার পদ্ধতি। প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের জন্য গর্ভনিরোধ দ্রব্যাদি ব্যবহার এবং গর্ভ প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, সময় অপচয় করার অবকাশ নেই।

বর্তমানে বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রতি অর্থ বছর অন্তর বিশ্বের জনসংখ্যা একশত কোটি করে বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যেই বিশ্বের জনসংখ্যা ছয়শত কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। সুতরাং প্রত্যক্ষ উপায় ছাড়া জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার সীমিত করার পক্ষপাতী জনসংখ্যাবিদদের মতে জন্মহার দ্রুত কমাতে গেলে গুরুত্ব দেয়া উচিত অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের প্রতি । জীবনযাত্রার মান উন্নত করার প্রয়োজনে মানুষ জন্মহার সীমিত রাখতে সচেষ্ট হবে। পরোক্ষ পদ্ধতির সমর্থকদের যুক্তি হচ্ছে, প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মনিরোধের আশু ফল লাভ করা গেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কারণ পরিবার সীমিত রাখার তাগিদ অনুভব না করলে, সাধারণ লোকের পক্ষে জন্মনিয়ন্ত্রণের কার্যকর প্রচেষ্টা গ্রহণ করারই কথা নয়। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত এজন্য যে, বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে যথেষ্ট সময় নেয়ার সুযোগ নেই।

১৯৯১ সালের আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.১৭ এবং এ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আগামী বত্রিশ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এমতাবস্থায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণই অধিক যুক্তিযুক্ত। প্রত্যক্ষ পদ্ধতি গ্রহণ ব্যতীত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বিশেষ করে বাংলাদেশে। তবে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি অবলম্বনের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে-জনগণের মধ্যে ছোট পরিবার গঠনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি। ছোট পরিবার গঠন যাতে সর্বস্তরে জনগণের নিকট কাম্য হয়, সে জন্য জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ব্যতীত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান অনেকাংশে দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করছে। এজন্য দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত পরিবারের আকাঙ্খা সৃষ্টি না করতে পারলে, শুধু পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব নয়। জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের আকাঙ্খা সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞমহল মত পোষণ করেন।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা মোকাবেলা করার বাস্তবসম্মত উপায় হচ্ছে প্রত্যক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। আবার পরিকল্পনা পদ্ধতিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য অপরিহার্য হলো পরোক্ষ উপায়ে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। পরোক্ষ উপায় গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *