“মিয়া ভাই” খ্যাত নায়ক ফারুকের জীবনাবসান

বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের আরেকটি নক্ষত্রের অবসান হলো। মারা গেছেন ‘ মিয়া ভাই’ নামে খ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ওরফে নায়ক ফারুক। চলচ্চিত্র পাড়ায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

গত ১৫ই মে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার আগে দীর্ঘ আট বছর ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এই অভিনয়শিল্পী ও রাজনীতিবিদ। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান তিনি। পরীক্ষায় রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এর পর থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করছিলেন তিনি। সিঙ্গাপুরে নিজের পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে ভর্তির কয় দিন পর তাঁর মস্তিষ্কেও সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে যে কয়েকজন অভিনেতা সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন তার মধ্যে ফারুক অন্যতম। অভিনয় জীবনে শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করার পরে ফারুক যোগ দেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসনে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হলেও সকলের কাছে তিনি ছিলেন নায়ক ফারুক।

গ্রামীণ প্রতিবাদী চরিত্রে ফারুক ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং সেটাই তার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। এক সাক্ষাৎকারে ফারুক জানিয়েছিলেন অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং ফারুক নামের নিজের একজন বন্ধু মিলে দিয়েছিলেন তার ঐ পোশাকি নাম ‘ ফারুক’।  দুলু থেকে যে নামে তিনি দর্শক এবং সহকর্মীদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত এবং জনপ্রিয়।

আকবর হোসেন পাঠান থেকে নায়ক ফারুক

অভিনেতা ফারুক ১৯৪৮ সালের ১৮ই আগস্ট পুরনো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস গাজীপুরের কালীগঞ্জে। তার মূল নাম ছিল আকবর হোসেন পাঠান দুলু। বাবা আজগর হোসেন পাঠান ছিলেন একজন চিকিৎসক। ছোটবেলা থেকেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র হাতে ফারুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ছোটবেলায় যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখে বড় হলেও ধীরে ধীরে ফারুক অভিনয় জগতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। গ্রামের টগবগে তরুণ থেকে শহুরে নানা বৈচিত্রময় চরিত্রে প্রায় চার দশক সিনেমা প্রেমীদের মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই ফারুক অভিনয় জগতে জড়িয়ে পড়েন। “জল ছবি” নামের ফারুকের প্রথম সিনেমা একাত্তরের পর মুক্তি পায়। সেই সিনেমায় তার নায়িকা ছিলেন “সারেং বউ” খ্যাত কবরী। তাদের সেই জুটি আজও দর্শকদের কাছে “সুজন সখী” নামে পরিচিত। ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে আকবর হোসেন পাঠান ফারুক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নির্মাতা আতাউর রহমান খানের। যার হাত ধরে এগিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিত্র এবং প্রমদ করের মতো পরিচালকেরা ফারুককে বেছে নেন সিনেমা নির্মানের জন্য।

“সারেং বউ”, “লাঠিয়াল”, “নয়ন মনি”, “গোলাপি এখন ট্রেনে”, ” দিন যায় কথা থাকে”, “জনতা এক্সপ্রেস”, “সাহেব”,  “মিয়া ভাই”, “নাগরদোলা”, “সুজন সখি”, “ঘর জামাই”, “ভাই ভাই “, “বিরাজ বউ”- এর মত দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। এসব সিনেমাতে অভিনয় করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ফারুক।

“মৃত্যুর দুদিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে ফারুকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। বলেছিলেন ভাই ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে দ্রুতই আমি বাড়ি ফিরব। বাড়ি ফিরলো ঠিকই কিন্তু জীবিত নয়, লাশ হয়ে।” মঙ্গলবার (১৬ মে) দুপুরে চিত্রনায়ক ফারুক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার আপন ফুফাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম এ কথা বলেন।  তিনি আরও বলেন, গ্রামীণ পটভূমিতে তিনি খুব মানানসই ছিলেন। রুপালি পর্দায় তিনি গ্রামীণ চরিত্রে খুব সাবলীল ছিলেন। ফারুক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বুবু নামে ডাকতেন। যখনই তিনি স্থানীয়ভাবে কারও জন্য নৌকার ভোট চাইতেন জনগণদের বলতেন, ‘আমি আপনাগো পোলা, আপনাগো কাছে নৌকার ভোট চাইতে আইছি’।

তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সাধারণ জনগণ থেকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে অনেক অভিনয়শিল্পী এবং পরিচালক ও প্রযোজকগণ। চিত্র নায়ক শাকিব খান নিজের ফেসবুক পাতায় বলেছেন, “চলে গেলেন আমাদের মিয়া ভাই! যতদিন তিনি সুস্থ সকল ছিলেন ততদিন আমাকে স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। আমার যে কোন ভাল কাজ এর খবর শুনলে তিনি সবসময় তা এপ্রিশিয়েট করতেন।’

সহকর্মী ও অভিনেতা মিশা সওদাগর জানিয়েছেন ” বিদায় মিয়া ভাই “। ফেসবুকে ফারুকের সাথে নিজের একটি ছবিও শেয়ার করেছেন মিশা ।

ফারুকের মৃত্যুতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে তার অবদান কখনোই বাঙালি জাতি ভুলবে না। বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আপনি অভিনয়ের মাধ্যমে যে স্থান দখল করেছেন তার অভাব কখনো পূরণ হবার নয়।

আরও পড়ুন- পরীমনির সংসার বৃত্তান্ত!

আরও পড়ুন- অপুকে কতবার গর্ভপাত করিয়েছিলেন শাকিব খান?

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *