বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ ও প্রতিকার, সন্তানের উপরে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রভাব

বিবাহ বিচ্ছেদ বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক সমস্যা। দিন দিন বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতিনিয়তই ভাঙ্গছে হাজারো পরিবার। নারীর যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি একটা পুরুষেরও হাজারো সমস্যা হচ্ছে এই বিচ্ছেদের কারণে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো রির্পোটে দেখা যাচ্ছে যে, গত ৭ বছরে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৩৪ ভাগ। যেখানে নারীরাই ৭০ ভাগ বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার সব থেকে বেশি ঢাকা সিটিতে। ঢাকার অভিজাত অঞ্চলখ্যাত উওর সিটিতে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৭৫ ভাগ।

বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ

বর্তমান আধুনিক সমাজে সুন্দর সাজানো প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দেখা যাচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আরও অনেক কারণ আছে। যেমন: স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল না থাকা, তাদের মনের মিলন না ঘটা, পারিবারিক সমস্যা, নারীর বিভিন্ন ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কিংবা পুরুষের বাহিরে পরকীয়ার কারণ ইত্যাদি। নিম্নে বিবাহ বিচ্ছদের কিছু প্রধান কারণ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

ব্যাক্তিত্বে অমিল: ২০১৩ সালে ‘Institute for divorce financial analysts’ একটি সমীক্ষা করে, যেখানে দেখা যায় বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারন হলো ব্যক্তিত্বের অমিল। দুজনের মাঝে পারস্পরিক অসঙ্গতি, নিজস্ব স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং ইচ্ছে সব কিছুতে যখন পার্থক্য দেখা যায় তখন ওই পরিবার বেশ জটিল হয়ে পড়ে। যার কারণে পরিবারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, মারামারি, কথা কাটাকাটি হয়ে একটা সময় বিচ্ছেদে রূপ নেয়। শেষ হয়ে যায় একটা পরিবার, আলাদা হয়ে যায় দুটি মানুষ।

সঠিক যোগাযোগের অভাব: যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজের সন্ধানে বা চাকরি সূত্রে স্বামী যদি দেশের বাহিরে বা অন্য কোন জেলায় থাকে তখন সেই দম্পতির মধ্যে যোগাযোগ অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্দেহের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাদের মধ্যে পরিপূর্ণ বিশ্বাস না থাকার কারণেই এমন ঘটনা ঘটে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, যোগাযোগ ঠিকই আছে কিন্তু যে কোনো একটা মানুষের খারাপ আচরণ অন্য একটা মানুষকে কষ্ট দেয় তখন যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয় এবং বিবাহ বিচ্ছেদের সূত্রপাত ঘটে।

প্রত্যাশা পূরণের অভাব: বিবাহের আগে যদিও ছেলে-মেয়ে দুজনেই দুজনের সম্পর্কে জেনে নেয়, কিন্তু যখন তারা একসাথে থাকা শুরু করে তখন তাদের মধ্যে অনেক ইচ্ছে বা শখ জাগে। যখন এগুলো তাদের পূরণ হয় না ঠিক তখন দুইটা মানুষ আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। বিয়ের পরে ও আগে দুইটা মানুষ যখন বাস্তবতার সম্মুখীন হয় তখন এধরনের ঘটনা ঘটে।

পরিবারের সদস্যদের অনধিকার চর্চা: স্বামী স্ত্রীর মাঝে যে কোন সময় যে কোন জিনিস নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে পারে। কিন্তু এর মাঝে যদি পরিবারের লোকজন একপক্ষ হয়ে বিচার করে তখন অনেক বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয় দাম্পত্য জীবনে। পরিবারের মানুষগুলো যখন নানা উপদেশ দেয়, মানসিক যন্ত্রণা দেয় তখন স্বামী স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। এটাও অনেক বড় ধরনের একটি সমস্যা।

র্ধৈযের অভাব: প্রতিটি পরিবারেই হয় স্বামী, না হয় স্ত্রী ভুল কোন কাজ করে ফেলতে পারে বা তাদের বিয়ের আগের অনেক অভ্যাস পরিবর্তন করতে তাদের অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়। যখন দুইটা মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করতে একটু সময়ের দরকার হয় তখন তারা এটা নিয়ে র্ধৈয না ধরেই ঝগড়া শুরু করে। যার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা: বিয়ের পর ক্যারিয়ার আর পারিবারের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে  দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। বিয়ের পর স্বামীরা আশা করেন তার স্ত্রী চাকরি ছেড়ে পরিবারকে সময় দিবে, আর স্ত্রী চায় তার স্বামীর অফিস টাইম ছাড়া বাকি যে সময়টুকু সে পায় সেই সময়টুকু যেন স্ত্রীকে দেয়। যখন এমন চাওয়া তাদের পূরণ হয় না, তখন ঝামেলার সৃষ্টি হয়। তবে প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীর উচিত একে অপরের কথা মেনে চলা এবং যে যেটা পছন্দ করে সেভাবে কাজ করা। তাহলেই সংসার জীবন হবে সুন্দর।

মানসিক প্রশান্তির অভাব: বিবাহিত জীবন যখন অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন মানুষ বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। অপরপক্ষে সন্দেহ, শারীরিক নির্যাতন, অবহেলা এগুলো বেশ প্রভাব ফেলে বৈবাহিক সম্পর্কে।

অত্যাচার: বর্তমানে বেশিরভাগ বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হয় অত্যাচার। একটা মানুষকে শারীরিক মানসিক অত্যাচার করার কারণে সেই মানুষটা কর্কট হয়ে যায়। খারাপ আচরণ করে। এমন করতে করতে এক সময় বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের প্রতিকার

বিবাহ বিচ্ছেদ প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে আইনজীবীরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সুন্দর একটা পরিবার যখন বিচ্ছেদ বেছে নেয় তখন একজন এডভোকেট সব সময় দুই পরিবারকে মিল করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন তারা দেখে পরিস্থিতি খুব খারাপ, তখন তারা দুই পরিবারের মতামত অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে দেয়। একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়, সেই সাথে দুটি মানুষ আলাদা হওয়ার কারণে তাদের ঘরে জন্ম নেয়া শিশুরা হারিয়ে ফেলে মা-বাবার ভালোবাসা। এতে সন্তানদের তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা হয় না।

আমাদের সমাজে প্রতিটি মানুষের উচিৎ বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে দূরে থাকা, বিবাহ বিচ্ছেদ হবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করা, নারীর অধিক স্বাধীনতা না চাওয়া, স্বামী অফিস ব্যতীত বাহিরে মেয়েদের সাথে না থাকা, সন্দেহ হবে এমন পরিস্থিতিতে না যাওয়া। স্বামীর উচিত স্ত্রীর কথা মেনে চলা এবং স্ত্রীর উচিত স্বামীর কথা মেনে চলা। যদি দুইটা মানুষ তাদের ভালো লাগা ভালোবাসা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে এবং স্বামীর আয় অনুযায়ী স্ত্রী তার শখ পূরণ করতে পারে তাহলে কমে যাবে বিচ্ছেদের হায়। প্রতিটা শিশু বেড়ে উঠবে মা-বাবার ভালোবাসায়। তাদের মানসিক বিকাশ ঘটবে। তারা শিক্ষার আলো পাবে, সুন্দর হয়ে উঠবে পরিবারগুলো। সুখ ও শান্তিময় হবে সবার জীবন।

বিবাহের পরে স্বামী ও স্ত্রী তাদের দুজনের মতামত নিয়ে কাজ করবে। মনের মিল ঘটবে যার সাথে তার সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া দরকার। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কাজ না করা, দুজনের মত প্রকাশে স্বাধীনতা দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া- এইসব বিষয় যদি আমরা খেয়াল রাখি তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদ অনেকটা কমে আসবে ।

সন্তানের উপর বিবাহ বিচ্ছেদের প্রভাব

একটা বিচ্ছেদ কেবল একটা পরিবারকেই ধ্বংস করে না, তাদের পরিবারে থাকা প্রতিটা সন্তানের জন্য এই বিচ্ছেদ একটা কষ্টকর পরিস্থিতি। মা-বাবার সম্পর্ক না থাকার কারণে সমাজে ওই শিশুগুলো হয় অবহেলিত। তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। তারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। তাদের যত্ন এবং ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার মানুষ থাকে না। সুন্দর জীবন নষ্ট হয়ে যায় মূহুর্তের মধ্যে। তারা শিক্ষার আলো যথাযথভাবে পায় নাহ। এতে তারা খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে দ্রুত। এভাবেই শিশুগুলোর জীবন নষ্ট হয়ে যায় মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে।

পরিশেষে, আমাদের সমাজের প্রতিটা মানুষের উচিত তাদের সম্পর্কগুলোকে সঠিক মূল্যায়ন করা। বিচ্ছেদ না ঘটিয়ে তাদের পাশে থেকে তাদেরকে ভরসা দেওয়া এবং তাদের ভালো কাজগুলোকে সাপোর্ট করা।দুইটা মানুষের ব্যক্তিত্বের মাঝে নাক না গলানো। এভাবে আমরা একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে বিচ্ছেদ কমিয়ে ফেলতে পারি। বিচ্ছেদ কম হলে দেশ হবে সুন্দর, পরিবার গুলো থাকবে আনন্দময়।

আরও পড়ুন- অপুকে কতবার গর্ভপাত করিয়েছিলেন শাকিব খান?
আরও পড়ুন- পরীমনির সংসার বৃত্তান্ত!

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *