বাংলার বারোভূঁইয়াদের ইতিহাস
বারোভূঁইয়া
সম্রাট আকবর সমগ্র বাংলার ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। বাংলার বড় বড় জমিদার মুঘলদের অধিনতা মেনে নেন নি,তারা সবাই স্বাধীন ছিলেন। কেউ কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেননি। তাদের অনেক শক্তিশালি সৈন্য ও নৌবহর ছিলো। তারা সকলেই একজোট হয়ে মুঘল সেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার ইতিহাসে এ জমিদারগণ বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। এখানে বারো বলতে বার জনকে বুঝায় নি,তারা অনেক লোক একজোট হয়ে ছিলেন বিধায় তাদের নামকরন করা হয়েছিলো বারোভূঁইয়া। তারা সকলেই ছিলেন জমিদার এবং সবাই স্বাধীন ছিলেন।
বাংলার ইতিহাসে বারোভুঁইয়াদের আগমন ঘটে ষোলো শতকের মাঝামাঝি বা সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। আলোচ্য সময়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তারাই বারোভূঁইয়া। এছাড়াও বঙ্গদেশে আরও অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিলেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এভাবেই বারোভুঁইয়াদের আগমন ঘটে এবং তারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেন।
ঈসা খান,মুসা খান তাদের বসবাসযোগ্য এলাকা ছিলো ঢাকা জেলার অর্ধাংশ ময়মনসিংহ জেলা এবং রংপুরের কিছু অংশ।চাঁদরায় ও কেদার রায় এর এলাকা ছিলো শ্রীপুর। বাহাদুর গাজির এলাকা ছিলো ভাওয়াল। সোনা গাজি সরাইল। ওসমান খান সিলেট। বীর হামির বিষ্ণুপুর(বাকুডা)। লক্ষন মানিক্য নোয়াখালি।পরমানন্দ রায় বরিশাল। বিলোপরায় মধু রায় এর এলাকা ছিলো মানিকগঞ্জ। মুকুন্দরাম ফরিদপুর। রামচন্দ্র বরিশালের কিছু এলাকা।
প্রথমদিকে বারোভুঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খানের পিতা সোলায়মান খান,তিনি সোনারগাঁ অঞ্চলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। এ থেকেই শুরু হয় বারোভুঁইয়াদের জমিদারি ও রাজত্ব। খিজিরপুর দূর্গ ছিলো তার প্রধান শক্তির কেন্দ্র। সোনারগাঁ ও খিজিরপুরের নিকটবর্তী কাত্রা তার রাজধানী ছিলো। দাউদ কররানির পতনের পরই তিনি সোনারগাঁও রাজধানী স্থাপন করে নেন।
বারোভূঁইয়াদের দমন করার জন্য সম্রাট আকবর প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৫৮০ খ্রি: শাহবাজ খান,১৫৮৫ খ্রি: সাদিক খান,১৫৮৬ খ্রি: উজির খান,এবং ১৫৯৪ খ্রি: রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তারা ঈসা খানের সাথে বহুবার যুদ্ধ করছেন। কিন্তু বারোভুঁইয়াদের প্রথম নেতা ঈসা খানকে পরাজিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তাদের পক্ষে। সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারের বিনিময় তিনি তাঁর আধিপত্য বজায় রাখেন। অন্যদিকে তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোসনা করে মসনদ -ই-আলা উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৫৯৯ খ্রি: বারোভূঁইয়া নেতা ঈসা খানের মৃত্যু হয়। এরপর বারোভুঁইয়াদের নেতা হন তার পুত্র মুসা খান। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহকে দ্বিতীয় বারের মতো বাংলায় পাঠানো হয়। ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসা খান নৌযুদ্ধ পরাজিত হন কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার আগেই মানসিংহ শুনতে পারেন সম্রাট আকবরের অসুস্থতার কথা।তখন সে নিজ থেকেই চুপ হয়ে থাকেন এবং যুদ্ধ ওখানেই শেষ করে দেন। অতঃপর সম্রাটের ডাকে মানসিংহ আগ্রায় ফিরতে বাধ্য হন।
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পরে তার পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীর নামধারন করে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তিনি মানসিংহকে আবার বাংলায় প্রেরন করেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কুতুবউদ্দিন কোকাকে(১৬০৬)খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। কুতুবউদ্দিন শের আফকুনের হাতে প্রান হারালেন এবং পরবর্তী বছরে জাহাঙ্গীর কুলি খান মৃত্যু বরন করেন। এরপর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান সুবাদার নিযুক্ত হন।
বাংলার বারোভুঁইয়াদের দমন করা মুঘলদের কৃতিত্বপূর্ন কাজ। আর এ কৃতিত্বপূর্ন কাজের দাবিদার ইসলাম খান(১৬০৮-১৬১৩ খ্রি:)। শাসনভার গ্রহন করেই তিনি বুঝতে পারেন যে বারোভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে দমন করতে পারলেই তার পক্ষে অন্যান্য জমিদারদের বশীভূত করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।এজন্যই তিনি তার সবটুকু দিয়ে মুসা খানকে দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। সেজন্য তিনি রাজমহল থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ মুসা খানের ঘাঁটি সোনারগাঁ ঢাকার অদূরে ছিলো। বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় আসার পথে ইসলাম খান কয়েকজন জমিদারের আনুগত্য লাভ করেন। বারোভুঁইয়াদের দমন করার জন্য ইসলাম খান শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। মুসা খানের সাথে ইসলাম খানের প্রথম সংঘর্ষ হয় ১৬০৯ খ্রি: করতোয়া নদীর পূর্বতীরে যাত্রাপুরে। সেখানেই ছিলো বারোভূঁইয়া নেতা মুসা খানের দূর্গ। সেই যুদ্ধে মুসা খান ও অন্যান্য জমিদাররা পরাজিত হয়ে যায়। ইসলাম খান ১৬১০ খ্রি: ঢাকায় প্রবেশ করেন। ওই সময় থেকেই ঢাকা হয় বাংলার রাজধানী এবং সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নামকরন করা হয় জাহাঙ্গীরনগর।
এরপর পুনরায় বারোভূঁইয়া নেতা মুসা খানের নেতৃত্বে মুঘলদের বাধা দেওয়ার জন্য নৌবহর একত্রিত করা হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ইসলাম খান পশ্চিমে তার সৈন্য ও নৌবহর প্রেরন করেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় যুদ্ধ উক্ত যুদ্ধে নদীর পাড়ে মুসা খানের দূর্গ মুঘলদের অধিকারে চলে আসে। এমতাবস্থায় মুসা খান সোনারগাঁ ফিরে আসেন। এখানে এসে বুজতে পারেন নিজের রাজধানী নিরাপদ জায়গা নয় তখন তিনি মেঘনা নদীতে আশ্রয় নেন। মুঘল সৈন্যরা দখল করে নেন সোনারগাঁ যার কারণে জমিদারগন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ইসলাম খান মুসা খানকে অন্যান্য জমিদারদের মতো মুঘলদের অধিনস্ত করে নেন। পরে মুসা খান সম্রাটের আনুগত্য জায়গিরদার হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। মুসা খানের আত্মসমর্পণ দেখে অন্যান্য জমিদাররা সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন। এভাবেই বাংলায় বারোভুঁইয়াদের অবসান ঘটে।
বারোভুঁইয়ারা কোনো রাজপরিবারের বংশধর ছিলেন না। তারা সকলেই ছিলেন দেশপ্রেমিক জমিদার ও জমির মালিক। অদম্য সাহসিকতা নিয়ে দীর্ঘ তিন যুগ ধরে মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছেন তারা। দেশ প্রেমিক বারোভুঁইয়ারা ইতিহাসের পাতায় স্মরনীয় হয়ে আছেন।