বিশ্বকাপ ও লিওনেল মেসি: সাধারণ থেকে সর্বকালের সেরা
২২ নভেম্বর, ২০২২। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে যাবে আর্জেন্টিনা। হারবেন লিওনেল মেসি। হতাশায় স্তব্ধ হবে পুরো বিশ্ব। ঠিক ২৬ দিন পর আবার সেই লুসাইল স্টেডিয়াম! এবার ফাইনাল। মাঠে নেমেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার কীর্তি গড়বেন মেসি। বিশ্বকাপটা জিতেও যাবেন। ফুটবলের কবি খ্যাত পিটার ড্রুরি ঘোষণা করবেন, ‘Scaloni will be fated, Messi will be sainted’।
৫ বিশ্বকাপ আর ২৬ ম্যাচের যাত্রা শেষে সর্বকালের সেরার বিতর্কে ইতি টানবেন লিওনেল মেসি। যদিও এসব অমর কীর্তিগাঁথার শুরুটা আরও অনেকটা দিন আগে। ফিরে যেতে হবে ২০০৬ সালের জুন মাসে।
বিশ্বকাপ ২০০৬: নতুন ম্যারাডোনার প্রথম পদচিহ্ন
১৯৯৪ সালের পর থেকে আর্জেন্টিনা খুঁজে ফিরছিল নতুন এক ম্যারাডোনাকে। আরিয়েল ওর্তেগা, স্যাভিওলা, হুয়ান রিকুয়েলমেসহ অনেকের নামের পাশেই বসেছিলো নতুন ম্যারাডোনার তকমা। ২০০৬ সালে তেমন একজনের নামই শুনলো বিশ্ব। ১৮ বছরের সেই তরুণের নাম লিওনেল মেসি।
১৬ জুন, ২০০৬। সার্বিয়া এন্ড মন্টেনিগ্রোর বিপক্ষে ৭৪ মিনিটে মাঠে নামলেন সেই তরুণ মেসি। গ্যালারিতে তখন শিশুর মত করে উল্লাসে মেতেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। চার মিনিট পরেই মেসির পাসে সহজ গোল করলেন হার্নান ক্রেসপো। মাঠে ততক্ষণে সত্যিই নিজের জাদু দেখাচ্ছেন মেসি। ৮৮ মিনিটে পেয়ে যান নিজের প্রথম বিশ্বকাপ গোলটাও। বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম বয়েসী আর্জেন্টাইন হিসেবে গোলের কৃতিত্বটাও গড়লেন একই সাথে।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পরের ম্যাচে শুরুর একাদশেই ছিলেন মেসি। রাউন্ড অভ সিক্সটিনে মেক্সিকোর বিপক্ষে গোলও পেয়েছিলেন। তবে বিতর্কের জন্ম দিয়ে সেই গোল বাতিল করা হয়। ম্যাচটা অবশ্য অতিরিক্ত সময়ে জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
কোয়ার্টারে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক জার্মানি। আগের ম্যাচগুলোয় দারুণ পারফর্ম করা মেসিকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এদিন বসিয়ে রাখবেন কোচ হোসে পেকারম্যান। পেনাল্টি শ্যুটআউটে বাদ যাবে আর্জেন্টিনা। তবে বিশ্ব জানবে, ‘মেসি ছেলেটা সত্যিই ম্যারাডোনার মতো খেলে।’
বিশ্বকাপ ২০১০: ম্যারাডোনা-মেসির হতাশার যুগলবন্দী
জীবনে ক্ষ্যাপাটেপনা কম করেন নি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার কোচ হয়েও সেই ধারা বজায় রাখলেন তিনি। আফ্রিকা বিশ্বকাপের দলে জায়গা পেলেন না দুই অভিজ্ঞ আর্জেন্টাইন হাভিয়ের জানেত্তি এবং এস্তেবিয়ান ক্যাম্বিয়াসো। এমনকি নেই হুয়ান রিকুয়েলমে! দলের মুখ্য ভূমিকায় ২২ বছরের মেসি। মেসি অবশ্য ততদিনে নিজ সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে এসেছেন। আগের বছরই পেয়েছেন ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরষ্কার।
তবে বার্সেলোনার সুপারস্টার মেসি আর্জেন্টিনায় কেমন যেন বিবর্ণ। কোয়ালিফাই পর্বে ১৮ ম্যাচে মোটে ৪ গোলের পরেও বিশ্বকাপে তাকে নিয়ে আশাবাদী সবাই। মেসি খেলেছিলেন নিজের মতো করেই। তার দারুণ প্লেমেকিং ব্যবধান গেড়েছে প্রতি ম্যাচেই। তবে গোল বা অ্যাসিস্টে নাম নেই এলএমটেনের। আফ্রিকা বিশ্বকাপে মেসির একমাত্র অ্যাসিস্ট এসেছিলো রাউন্ড অভ সিক্সটিনে মেক্সিকোর বিপক্ষে।
কোয়ার্টারে আবারও সেই জার্মানি। যার কাছে ২০০৬ সালে হেরেছেন মেসি। ১৯৯০ সালে ফাইনাল হেরেছিলেন ম্যারাডোনা। মেসি-ম্যারাডোনা যুগলবন্দী আবার ধরাশায়ী হলো সেই জার্মানিতেই। ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হলো আলবিসিলেস্তেরা। ম্যাচ শেষে মেসি জানালেন আবারও ফিরবেন তিনি।
বিশ্বকাপ ২০১৪: এত কাছে তবু এত দূরে
চিরপ্রতিদ্বন্দী ব্রাজিলের মাটিতে বিশ্বকাপ। মেসি ততদিনে গ্রহের সেরা ফুটবলার। টানা চারবার জিতেছেন ফিফার সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি। যদিও একটা অপবাদ রয়েই গিয়েছে। জাতীয় দলে মেসি অচল। প্রথম ম্যাচেই সেই অপবাদের জবাব দিলেন। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার বিপক্ষে অন্তিম সময়ে ডিবক্সের বাইরে থেকে দারুণ গোলে অবাক করলেন সবাইকে। পরের ম্যাচে আরো একবার দলকে খাদের কিনারা থেকে তুললেন। ইরানের বিপক্ষে জয়সূচক গোলটা এলো ইনজুরি টাইমের শেষ মিনিটে।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ নাইজেরিয়া। আর্জেন্টাইন কোচ আলেসান্দ্রো সাবেয়া মেসিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন শুরু থেকেই। মেসিও তার প্রতিদান দিলেন দুই গোল করে। গ্রুপ পর্বটায় দলকে একাই টেনে তুললেন মেসি।
দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইসদের বিপক্ষে এক অ্যাসিস্ট আর কোয়ার্টারে বেলজিয়ামের বিপক্ষে দারুণ প্লে-মেকিং! ২৪ বছর পর বিশ্বকাপের শেষ চারে আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালে নায়ক হলেন অবশ্য সার্জিও রোমেরো এবং হাভিয়ের মাশ্চেরানো।
২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল। আর্জেন্টিনার সামনে সেই জার্মানি! যাদের কাছে আগের দুই আসরে বিদায় নিয়েছিলেন মেসি। এবার হয়ত সব হিসেব চুকে যাবে। কিন্তু ফাইনালে হিগুয়েন খলনায়ক বনে গেলেন। মেসিও হতাশ। ১১৩ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় মারিও গোটজা কেড়ে নিলেন সব আলো। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের ‘গোল্ডেন বল’ পুরষ্কার হাতে পেলেও অধরা বিশ্বকাপটা থেকে দূরেই রইলেন মেসি!
৩ বিশ্বকাপ শেষে মেসির অর্জনে ৫ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট, একটা গোল্ডেন বল। সেইসাথে ফাইনাল হারার যন্ত্রণা।
বিশ্বকাপ ২০১৮: নড়বড়ে আর্জেন্টিনায় মেসির হতাশা
২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনাল। টানা ৩ ফাইনাল হেরে মেসি ঘোষণা দিলেন জাতীয় দলে আর না। বার্সেলোনার মেসি আর্জেন্টিনায় ব্যর্থ এই কথার সত্যতা যেন নিজেই দিলেন। তবে মেসি ফিরেছিলেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার খেলা যখন শঙ্কায়, তখনই মেসি খুললেন তার জাদুর বাক্স। ইকুয়েডরের বিপক্ষে দারুণ হ্যাটট্রিকে দলকে এনে দিলেন বিশ্বকাপের টিকেট। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন দলটা বড্ড নড়বড়ে। হোর্হে সাম্পাওলির শিষ্যদের নিয়ে খুব বেশি আশা রাখেননি কেউই।
আইসল্যান্ডের সাথে মেসির পেনাল্টি মিস আর ড্র, ক্রোয়েশিয়ার সাথে হার দিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা সত্যিই পড়লো শঙ্কায়। দুই ম্যাচেই নিষ্প্রভ মেসি। গ্রুপের শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে গোল পেয়েছিলেন অবশ্য। তবে রাউন্ড অভ সিক্সটিনেই থামতে হয়েছিলো আর্জেন্টিনাকে। ফ্রান্সের কাছে হার দিয়ে শেষ হয় মেসির বিশ্বকাপ যাত্রা। পুরো বিশ্বকাপে মেসির গোলসংখ্যা এক। অ্যাসিস্ট দুই।
বিশ্বকাপ ২০২২: কিংবদন্তী থেকে সর্বকালের সেরা
১৮ বিশ্বকাপের পর জাতীয় দল থেকে খানিক নির্বাসনেই চলে গেলেন মেসি। নতুন কোচ তখন আনকোরা এক মুখ। লিওনেল স্কালোনি। এই স্কোলানি ২০০৬ সালে ছিলেন মেসিরই সতীর্থ। স্কালোনির অধীনেই মেসি-নির্ভরতা কাটিয়ে অন্যরকম এক ফুটবল উপহার দিলো আর্জেন্টিনা। ২০২১ সালে কাটলো দীর্ঘ ২৮ বছরের শিরোপাখরা। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনা জিতলো ফিনালেসিমার ট্রফিও। ফেভারিটের তকমা নিয়ে কাতারে পা রাখলো মেসি এন্ড কোং।
কিন্তু প্রথম ম্যাচেই স্তব্ধ বিশ্ব! সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনার হার! অবশ্য দলটা ঘুরে দাঁড়ায় পরের ম্যাচ থেকেই। মেক্সিকোর সাথে এক গোল আর এক অ্যাসিস্টে দলকে জেতাতে মুখ্য ভূমিকা রাখলেন লিওনেল মেসি। এই অ্যাসিস্টের পর একমাত্র ফুটবলার হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে অ্যসিস্ট করার দারুণ রেকর্ড করলেন তিনি।
ক্ষুদে জাদুকর অবশ্য পরের ম্যাচে পেনাল্টি মিস করলেন। তবে নিজের স্বভাবসুল্ভ খেলায় দলকে সাহায্য করেছেন ঘুরে দাঁড়াতে। রাউন্ড অভ সিক্সটিনে নিজের ক্যারিয়ারের হাজারতম ম্যাচে মাঠে নামলেন মেসি। ম্যাচটা নিজের করে নিয়েছিলেন দারুণ এক গোলে। এটা ছিলো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে তার প্রথম গোল।
কোয়ার্টারে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস। পেনাল্টি থেকে মেসির গোল। ২০১৪ সালের মতো করেই আবারও ম্যাচ গেলো টাইব্রেকারে। এবারেও নায়ক বনে গেলেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক। নাম তার এমি মার্টিনেজ। এই মার্টিনেজই মেসিকে বিশ্বকাপ জেতাবেন পরে। ফাইনালে দারুণ সেইভে নায়ক হবেন তিনি।
সেমিফাইনালে একপেশে ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ধরাশায়ী করলো আর্জেন্টিনা। এক গোলের পাশাপাশি চোখ জুড়ানো অ্যাসিস্ট করে ম্যাচটা নিজের করে নিয়েছিলেন সেদিন। ২০১৪ সালের পর আবারও ফাইনালে আর্জেন্টিনা। মেসির চোখ শিরোপায়। কিংবদন্তী মেসির সামনে সর্বকালের সেরা হবার সুযোগ। তবে ততদিনে রেকর্ডবুকে মেসি আরেকটা রেকর্ড গড়লেন। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল এখন মেসির। আর সেইসাথে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের মালিকও তিনি।
লুসাইল স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপ ফাইনাল। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। মাঠে নেমেই রেকর্ড গড়লেন মেসি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২৬) খেলা ব্যক্তি এখন তিনিই। ২৩ মিনিটে গোল করলেন। বিশ্বকাপের সব রাউন্ডে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড়ের নামটাও এখন মেসি। ম্যাচটায় অবশ্য ফিরে এসেছিলো ফ্রান্স। এমবাপ্পের জোড়া গোলের পরেও দমে যায় নি আলবেসিলেস্তেরা। মেসি করেছেন আরও এক গোল।
শেষটা হয়েছে টাইব্রেকে। যেখানে জয়ী দলের নাম আর্জেন্টিনা। যার অধিনায়ক লিওনেল মেসি। এবারেও বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় তিনিই। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার গোল্ডেন বল জিতলেন। তবে এবার সাথে আছে অধরা ট্রফিটাও। কিংবদন্তীর তকমা পাওয়া মেসিকে কুর্নিশ জানালো সারা বিশ্ব। অবিস্মরণীয় বিশ্বকাপে মেসির পারফর্মও চোখ জুড়ানো। ৭ গোলের সাথে ৩ অ্যাসিস্ট।
বিশ্বকাপে মেসির পরিসংখ্যান
বিশ্বকাপ অংশগ্রহণ: ৫
ম্যাচ: ২৬ (সর্বোচ্চ)
মোট গোল: ১৩ (যৌথভাবে তৃতীয়)
মোট অ্যাসিস্ট: ৮
মোট গোল সহায়তা: ২১ (যৌথভাবে সর্বোচ্চ)
একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ২ বার গোল্ডেন বল
সেরা সাফল্য: চ্যাম্পিয়ন (২০২২ বিশ্বকাপ)
আরও পড়ুন- ভামোস শব্দের অর্থ কি? ভামোস আর্জেন্টিনা কেন বলা হয়?
আরও পড়ুন- বিশ্বকাপে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোঃ সম্ভাবনার শুরু থেকে হতাশার শেষ