বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ও তাঁর বীরত্ব

বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন

১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা,একটি স্বাধীন দেশ,একটি পতাকা। এগুলো আমাদের শক্তি ও সাহস দেয়।অসীম সাহসিকতা নিয়ে যারা যুদ্ধ করেছেন এ দেশের জন্য এ দেশের মানুষের জন্য তাদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন অন্যতম। নিজেরা স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছেন হানাদার বাহিনী থেকে। আমাদের দেশে যে ৭ জন বীরদের  বীরশ্রেষ্ঠ উপাধীতে  ভূষিত করা হয়েছে মোহাম্মদ রুহুল আমিন তাদেরই একজন। আমরা আজ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন সম্পর্কে জানবো।

জন্ম ও পরিচয়:

বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাঘপাচঁড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আজহার পাটোয়ারী এবং মাতা জোলেখা খাতুন।রুহুল আমিন তার মা বাবার আদরের প্রথম সন্তান। রুহুল আমিনের আরো ৫ ভাইবোন ছিল।

শিক্ষাজীবন:

প্রথমে তিনি বাঘপাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আমিশাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।এখানে তিনি এস এস সি পাশ করেন।১৯৫৩ সালে রুহুল আমিন জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন।

কর্মজীবনে রুহুল আমিন:

বীরশ্রেষ্ঠ- রুহুল-আমিন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তিনি করাচির নিকটবর্তী আরব সাগরের মধ্যে অবস্থিত মনোরা দ্বীপে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি (পি এন এস)বাহাদুরে যান । প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তিনি সেখান থেকে পি এন এস কারসাজে যোগদান করেন।এরপর তিনি সেখানে গিয়ে পি এন এস বাবর,পি এন এস খাইবার এবং পি এন এস তুঘরিলে দায়িত্বতার সাথে সব কিছুর তরারকি করেন তিনি।১৯৫৮ সালে তার সব প্রশিক্ষণ শেষ হয়েযায় এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিসিয়াম কোর্সের জন্য নিবার্চিত হন।সকল প্রশিক্ষণ শেষ করে রুহুল আমিন আর্টিফিসার পরে যুক্ত হন।১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি এন এস বখতিয়ার নৌঘঁটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যান। বাড়িতে গিয়ে ছাত্র, যুবক ও সামরিক আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। এর কিছুদিন পর ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা সেক্টর প্রধান কোয়ার্টারে যান এবং সেখানে মেজর শফিউল্লাহর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিনের ভূমিকা:

শুরু হয় ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। সেই যুদ্ধের সময় রুহুল আমিন চট্টগ্রাম কর্মরত ছিলেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করার জন্য পালিয়ে যান নৌঘাঁটি থেকে। সীমান্ত পেরিয়ে তিনি এিপুরা চলে যান। সাথে সাথে ২ নং সেক্টরে যোগ দিয়ে মেজর শফিউল্লাহের নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা সাব সেক্টর বা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছিলেন তাদের একত্রিত করেন আগরতলায় এবং ১০ নং সেক্টর গঠন করেন। আর্টিফিসার রুহুল আমিন নৌবাহিনীর সদস্যদের সাথে চলে যান কলকাতায় এবং ১০ নং সেক্টরের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের যুদ্ধ দেখে ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীকে দুটি গানবোট দেয়। অতঃপর তারা দুটি বোটে দুটি বাফার গান লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের ৪ টি মার্কমাইন লাগিয়ে ব্যবহারের উপোযোগী করে তোলেন। গানবোট দুটির নামকরন করা হয় পদ্মা ও পলাশ”৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধোদের হাতে যশোরের সেনানিবাসের ধ্বংস হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু ছুটতে থাকে। এসময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত খুলনা নৌঘাট দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। তখন তারা ভারতীয় গানবোটের সাথে যুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানেই পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।এরপর গানবোট গুলো রওয়া দেয় খুলনার উদ্দেশ্যে।

বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন:

৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর ‘পদ্মা’, ‘পলাশ’ এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট ‘পাভেল’ খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পি.এন.এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩টি জঙ্গিবিমান জাহাজগুলোর দিকে ছুটে আসে। পাকিস্তানি বিমান ভেবে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পরে বিমানগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জাহাজগুলোর উপর আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু ভারতীয় জাহাজটি সম্পূর্ণ অক্ষত থেকে যায়, কারণ বিমানগুলো সেটিকে লক্ষ করে হামলাই করেনি। প্রথম গোলা এসে পড়ে ‘পদ্মা’য় এবং পরবর্তীতে ‘পলাশে’। গোলা সরাসরি ‘পদ্মা’র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। ‘পদ্মা’-র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান ‘পলাশ’কে বাঁচানোর। তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায় এবং গোলার আঘাতে রুহুল আমিনের ডান হাতটি সম্পূর্ণ উড়ে যায়। অবশেষে পলাশের ধ্বংশাবশেষ পিছে ফেলেই আহত রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ যোদ্ধা একসময় পাড়েও এসে পৌঁছান। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে রাজাকারের দল অপেক্ষা করছে তার জন্য। আহত এই বীর সন্তান রাজাকারদের হাতে শহীদ হন।

বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করার কারণ:

যে মানুষ দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেন সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি দেশপ্রেমিক। নিজের দেশকে বাঁচানোর জন্য শত্রুদের সাথে করা লড়াই নৌবাহিনীর সকলকে একত্রিত করে সেক্টর গঠন করা এমন সব দুর্লভ কাজ করার জন্যই তিনি বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হন।

বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিনের সমাধিস্থল :

বীরশ্রেষ্ঠ-রুহুল-আমিনকে রূপসা নদীর পাড়েই শহীদ করা হয়। তাঁর মৃতদেহ বেশকিছুদিন সেখানে পড়ে ছিলো অযত্নে, অবহেলায়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করে এবং সেখান একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

এভাবেই বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষদের হত্যা করা হয়।ঝরে যায় এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় স্মৃতি এবং তাদের সাহসিকতার পরিচয়।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *