ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন কেমন ছিল?
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আগমন ও শাসনকাল ইতিহাসের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে বাণিজ্য করতে এসে ভারতসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রায় দুইশ বছর নিজেদের মত করে শাসন করেছিল ব্রিটিশরা। ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের বলা হয় ব্রিটিশ,যারা প্রাচীনকাল থেকেই থেকেই জ্ঞানবুদ্ধিতে কূটকৌশলী ছিল। ব্রিটিশ শাসন বলতে ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে বোঝায়।ইংরেজরা প্রধানত ভারতে বাণিজ্য করতে এসেছিল। ধীরে ধীরে ভারতে বণিকদের মানদন্ড রাজদন্ডে পরিণত হয় । ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর (১৭৬৫-১৯৪৭) ভারত শাসন করে।এই দুশো বছর তাদের শাসনের প্রভাবে ভারতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়।যা ব্রিটিশ পূর্ব যুগ ও ব্রিটিশ পরবর্তী যুগের মধ্যে এক বিশাল পার্থক সৃষ্টি করে ইতিহাসের পাতায়।
ব্রিটিশ শাসনের আগে ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রচলিত ছিল। মোঘল সম্রাট ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।তার নিয়ন্ত্রণ করার মত কোন আইন প্রচলিত ছিল না তখন। সম্রাটের আদেশ ই ছিল সর্বোচ্চ আইন। গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি এবং বদলি এইসব সম্রাটের মর্জিমত হতো।তার মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতো তার পুত্র। মুঘল শাসনামলে সরকারি কর্মচারীদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে পঞ্চায়েত গঠিত হত,,,পঞ্চায়েতরা এলাকা শাসন করত।ফৌজদার ছিলেন জেলার প্রধান কর্মকর্তা।তার অধীনে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব ছিল । জেলার উপরে ছিল সুবা বা প্রদেশ ।সুবার কর্মকর্তার নাম ছিল সুবাদার।সম্রাট কতৃক সুবাদারকে নিয়োগ দেওয়া হতো। সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে ছিল সুবাদার সর্বোচ্চ বেসামরিক ক্ষমতার অধিকারী ।কেন্দ্রের মত দেওয়ান পদ ও ছিল বেশ মর্যাদাপূর্ণ। রাজস্ব আদায়ের কাজ করতেন দেওয়ানী। মুঘল শাসন মূলত সম্রাটের দক্ষতার উপর নির্ভর করত।
১৪৯৮ সালের ২৭ মে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা সর্বপ্রথম ভারতে আসেন। ভাস্কো দা গামা এর আগে ১৪৮৭ সালে বার্থ লামিউ দিয়াজ নামক এক জন নাবিক উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার পথের সন্ধান দেন। সেই পথ ধরেই ভাস্কোদাগামা ১৪৯৮ সালে দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় কালিকটে এসে উপস্থিত হন।আর পর্তুগিজরা বাংলায় আসে ১৫১৬ সালে। বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্তুগিজরা দাস ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ভারতে পর্তুগীজদের ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত
তারপর আসে ডাচ বা ওলন্দাজ।হল্যান্ডের নাগরিকদেরকে পর্তুগিজ ভাষায় ওলন্দাজ বলা হয়। জাতীয়ভাবে তারা ডাচ নামে পরিচিত। ওলন্দাজরা সর্বপ্রথম ভারতে আসে ১৭০২সালে। তাদের কোম্পানির নাম ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । এটি ১৬০২সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ডাচদের পর উপমহাদেশে আসে ব্রিটিশরা।ইংরেজরা সর্বপ্রথম ভারতে আসে ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে। তাদের কোম্পানির নাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে আসে। সাধারণত ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে তারা পরিচিতি পেলেও তাদের কোম্পানির অফিসিয়াল নাম ছিল ‘The Governor and company of Marchant of London Trading into the East Indies’
অতঃপর বাণিজ্যের অনুমতি চেয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি কেপটেন হকিং ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস এর চিঠি নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আগমন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। ১৬১২-১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গুজরাটের সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।১৬৩৩ সালে তারা নামেমাত্র বাংলায় আসে এবং সীমিত পরিসরে বাণিজ্য শুরু করে। ১৬৫১সালে তারা সর্বপ্রথম বাংলার হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বাণিজ্যের পাশাপাশি বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দেয়া, স্থানীয় কৃষকদের উপরে অবিচার করা ,দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।১৬৮৬-৯০ সালের মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধে কোম্পানি পরাজিত হয় এবং তারা মুচলেকা ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রার্থনা করলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাদেরকে আবারও বাণিজ্য করার অনুমতি দেন এবং বাৎসরিক এককালিন ৩০০০ টাকা প্রদানের বিনিময় বাণিজ্যসহ সুতানটিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। ক্ষতিপূরণ ও মুচলেকা দিয়ে বাণিজ্য করা ও বসতি স্থাপন করার অনুমতি পাওয়ার পর
১৬৯০ সালে কোম্পানি সুতানটিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আশে পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের উপর স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করা,বাজার প্রতিষ্ঠা করা এবং একটি সুরক্ষিত বসতি স্থাপন করা। ১৬৯৭সালে কোম্পানি সুবেদার আজিমুশ্বান কে ১৬০০০ টাকা বার্ষিক নজরানা প্রদান করে কলকাতা সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারী সত্ব প্রার্থনা করে। ১৮৯৮ সালে নবাব কে বার্ষিক ১১০০ টাকা ১৪আনা ৪ পয়সা জমা দেয়ার শর্তে কোম্পানিকে উক্ত তিনটি গ্রামের জমিদারি প্রদান করা হয়। জমিদারী লাভের মাধ্যমে এই বণিক গোষ্ঠী ভারতের বৈধ শাসক শ্রেণীর অংশে পরিণত হয়। কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম ঘিরে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে । কলকাতায় তারা বাজার প্রতিষ্ঠা করে। অচিরেই কলকাতা দেশের অন্যতম বড় ক্রয়-বিক্রয় ও আমদানি রপ্তানির কেন্দ্রে পরিণত হয়।এদিকে ১৬৯৫-৯৬ সালের দিকে মেদিনীপুরের জমিদার সোভা সিংহ ও তার সঙ্গী রহিম খান বিদ্রোহ করলে আইনশৃংখলার চরম অবনতি ঘটে। ফলে বিদেশি বণিকরা নিজস্ব বাণিজ্য সামগ্রী রক্ষাসহ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করলে সুবেদার ইব্রাহিম খান তা মঞ্জুর করেন। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য নবাব কর্তৃক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলেও তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার গ্রহণের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি পার্থনা করে। অনুমতি পাওয়ার পর কোম্পানি ১৬৯৭ সালে সুতানটিতে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজা নামে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার সুযোগে নিরাপত্তার অজুহাতে দুর্গ নির্মাণ করলেও শান্তির সময় তারা কখনোই আর এই দুর্গ ধ্বংস করে নি। বরং নদীপথে ইউরোপীয় সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আনয়নের মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে তারা অত্যাধুনিক সামরিক দুর্গে পরিণত করে।
তার পরের ইতিহাস কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। এক্ষেত্রে নবাবের হিন্দু কর্মচারীরা ছিল ইংরেজদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি। কিন্তু তাদের যে কোনো একজনকে বাছাই করা হয়নি এই কারণে যে তাৎক্ষণিকভাবে এসময় কোন হিন্দুকে নবাবী মসনদে বসালে তা বাংলার জনগণ মেনে নিবে না। সেজন্যই কোম্পানি সিরাজউদ্দৌলার অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যক্তি মুসলিম বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলী খানকে নির্বাচন করে। সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটলে পরবর্তীতে মীরজাফরকে নবাব বানানো হবে এইরকম প্রলোভনে মীরজাফর এর সাথে কোম্পানির ১টি গোপন চুক্তি হয়। আর সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন হয় ১৭৫৭সালের ২৩শে জুন পলাশী প্রান্তরে। ষড়যন্ত্র চুড়ান্ত করে কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অতঃপর ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে অনুষ্ঠেয় পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের বাহিনীর নিষ্ক্রিয় থাকে। পরবর্তী দিনে যুদ্ধ করা হবে এই মর্মে মীরজাফর নবাবের নিকট যুদ্ধ বন্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করে। অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রধান সেনাপতির কথা শুনতে হয়। আর এখানেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়। মীর জাফরের বাহিনী নিষ্ক্রিয় হলে অন্য দিক থেকে রবার্ট ক্লাইভ নবাবের বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে নবাব পরাজিত হন। মীর মদন মোহন লাল আপ্রান চেষ্টা করেও প্রাণ বিসর্জন দেন। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
এভাবেই পরবর্তীতে দেশীয় শাসনব্যবস্থা কে চুর্ণ করে ব্রিটিশরা উপমহাদেশের শীর্ষ শাসনক্ষমতা লাভ করে এবং প্রায় দুইশত বছর শাসন ও শোষণ করে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে নিজেদের দেশে ফেরত যায়।