ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, জনসংখ্যা, মুসলিমদের আগমন
ভারতীয় উপমহাদেশ হলো এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি উপমহাদেশ, এটি হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতীয় টেকটিক পাতের উপর অবস্থিত এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত প্রসারিত এক সুবিশাল ভূখণ্ডের উপর বিদ্যমান। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ বলতে দক্ষিণ এশিয়াকেই নির্দেশ করা হয়। রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে অনেকে একে ভারতীয় উপমহাদেশ না বলে দক্ষিণ এশিয়া বলে থাকেন। ভারততত্ত্ববিদ রোনাল্ড বি. ইনডেন মনে করেন, ভারতীয় উপমহাদেশ শব্দটির চেয়ে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া শব্দটি বেশি প্রচলিত। কেননা এই শব্দের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়া থেকে এ অঞ্চলকে সহজেই পৃথক করা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশ পূর্বে গন্ডোয়ানার অংশ ছিলো। এটি ছিল একটি সুপার মহাদেশ যা নিওপ্রোটেরোজয়িক এবং প্রাথমিক প্যালিওজোয়িক সময়ে গঠিত হয়েছিলো। মূলত মেমোজোয়িক সময়ে গন্ডোয়ানা ভাঙ্গতে আরম্ভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশ ১৩০-১২০ মিলিয়ন বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা থেকে এবং ৯০ মিলিয়ন বছর আগে মাদাগাস্কার থেকে পৃথক হয়েছিলো। ভৌতগত দিক থেকে এটি দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার একটি উপদ্বীপীয় অঞ্চল যার উত্তরে হিমালয়, পশ্চিমে হিন্দুকুশ এবং পূর্বে আরাকানীদের দ্বারা চিত্রিত। এটির দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগর, দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ দিকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলের বেশির ভাগই ভারতীয় প্লেটের উপর অবস্থিত এবং বড় পর্বত বাধা দ্বারা এশিয়ার বাঁকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন।
আয়তন ও জনসংখ্যা
ভারতীয় উপমহাদেশের মোট আয়তন হলো ৪.৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার বা ১.৭ মিলিয়ন বর্গ মাইল। এই মহাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১.৮ বিলিয়ন।
এই অঞ্চলের দেশসমূহ
এই অঞ্চলের দেশগুলো হলো- ভারত,শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও নেপাল।
মুসলিম শাসন
ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন মুহম্মদ বিন কাসিম। তাইফে তথা বর্তমান সৌদি আরবে জম্ম গ্রহণকারী এই উমাইয়া সেনাপতি সিন্ধু নদসহ সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল জয় করে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সিন্ধু জয়ের কারণে মুসলিমদের পক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশ বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়।
মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান
মাত্র সতেরো বছরের উমাইয়া সেনাপতি মুহম্মদ বিন কাসিমের সৈন্য বাহিনিতে ছিলো ৬ হাজার পদাতিক, ৬ হাজার উষ্ট্রারোহী, ৩ হাজার তীরন্দাজ, এবং ৩ হাজার ভারবাহী পশু। মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য জলপথেও একদল সৈন্য প্রেরণ করা হয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ‘বলিস্ত’ নামক এক প্রকার ক্ষেপণাস্ত্র, যেটির মাধ্যমে ভারী পাথর দূরে নিক্ষেপ করে আঘাত করা যেতো।
মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথমেই দাইবুল বন্দর অবরোধ করেন। ব্রাহ্মণ ও রাজপুতগণ দাইবুল রক্ষার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালান। বিন কাসিম ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান সেনানায়ক। দাইবুলের প্রধান মন্দিরের চূড়ায় একটি লাল নিশান উড়ানো ছিলো। তিনি প্রথমেই বলিস্ত দিয়ে পাথর ছুড়ে নিশানটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। নিশানটি নামিয়ে ফেলা হলে হিন্দুদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তাদের ধারণা ছিলো মন্দিরের চূড়ায় যতোক্ষণ নিশান উড়বে ততোক্ষণ বাইরের কোনো শত্রু দাইবুল দখল করতে পারবে না। তারপরেও হিন্দুরা অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের উন্নত রণকৌশলের কাছে তারা পরাজিত হয়।
দাইবুল দখলের পর মুহম্মদ বিন কাসিম নিরুন, সিওয়ান ও সিসাম শহরগুলো একের পর এক দখল করে নেন। এ পর্যন্ত মুহম্মদ বিন কাসিম তেমন কোনো বাঁধার মুখোমুখি না হলেও রাওয়ার দুর্গ দখলের ব্যাপারে তাঁকে প্রচন্ড বাঁধার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে সিন্ধু রাজা দাহির এক বিশাল সৈন্য বাহিনীর সমাবেশ ঘটান। অতঃপর রাজা দাহিরের বাহিনীর সাথে মুসলমানদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। রাজা দাহির বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে রণক্ষেত্রেই প্রাণ ত্যাগ করেন। রাজার মৃত্যুতে হিন্দু সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে দাহিরের বিধবা পত্নী রাণীবাঈ দূর্গে আশ্রয় নেন। কিন্তু দূর্গে শেষ রক্ষা হবে না ভেবে তিনি অন্তঃপুরের অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জহরব্রত পালন করেন।
রাওয়ার দখলের পর মুহম্মদ বিন কাসিম ব্রাহ্মণ্যবাদ দখল করেন। এরপর সিন্ধুর রাজধানী আলোর দূর্গের পতন ঘটে। আলোর রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন দাহিরের এক পুত্র। আলোর জয় করে মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অঞ্চলে সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। এবার তিনি আরো উত্তরে অগ্রসর হয়ে মুলতান জয় করেন। মুলতান দখল করতে মুসলমানদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। হিন্দুগণ মুলতান রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। তারা প্রায় দু’মাস মুলতান দূর্গ রক্ষা করতে পেরেছিল। অবশেষে তাদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে মুহম্মদ বিন কাসিম মুলতান দখল করতে সক্ষম হন। মুলতান দখলের মধ্য দিয়ে রাজা দাহিরের রাজ্যের গোটাটাই মুসলমানদের দখলে চলে আসে।আর এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে নবদিগন্তের সূচনা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাণীর প্রবেশ ও বসতি স্থাপন
১০ হাজার বছরের বেশি পূর্ব থেকে আধুনিক মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রথম পরিযায়ীগণ ভারতে প্রবেশ করে প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে দক্ষিণের উপকূলীয় ভগ্নাঞ্চলের মধ্য দিয়ে। এরপর দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জটিল অভিপ্রয়াণ শুরু হয়। কৃষ্টির সূত্রপাতের সাথে দ্রাবিড় ও ইন্দো-ইউরোপিয়ানদের আগমনের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে পরিবর্তিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে মন্ড ও টিবেটো-বার্মান লোকদের আগমন ভারতীয় উপমহাদেশের জনসংখ্যায় নতুন উপাদান যোগ করে। আবার এ কথাও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, আর্যদের আগমন তত্ত্বের মতো বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে মানব অভিপ্রয়াণ বিষয়টি গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বিতর্কিত ক্ষেত্র।
এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান ও এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান
উপমহাদেশের দুটো প্রধান পূর্বপুরুষ উপাদানের ব্যাপারটি উপলব্ধি করেন রাইখ এট আল.। এদের মধ্যে এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান, যারা নিকট প্রাচ্য, মধ্য এশীয় এবং ইউরোপীয়দের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। আর এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান হলো তারা যারা এনসেস্ট্রাল নর্থদের থেকে বহুলাংশে আলাদা এবং যারা উপমহাদেশের বাইরের কোনো দলের সাথে নিকট সম্পর্কযুক্ত নয়। বসু এট আল. এর মতে, এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ানরা হলো ভারতের সর্বপ্রথম এবং আদিম বসবাস স্থাপনকারী গোষ্ঠী। এরা খুব সম্ভবত আফ্রিকা থেকে আগত দক্ষিণ দিকে যাওয়া তরঙ্গ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ৪,২০০ থেকে ১,৯০০ বছর পূর্বে মিশ্রিত হয়, যখন উপমহাদেশে এদের অন্তর্বিবাহ শুরু হয়, যা সম্ভবত ” হিন্দু গুপ্ত শাসকদের” জারি করা সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রথার ফলে শুরু হয়েছিলো। বসু এট আল. এর মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে আরও দুটো ভিন্ন পূর্বপুরুষ উপাদান রয়েছে যা ভারতীয় উপমহাদেশের জিন পুলে অবদান রেখেছে। এরা হলো এনসেস্ট্রাল অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং এনসেস্ট্রাল টিবেটো- বার্মান। তাঁর মতে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জনগণ একটি পঞ্চম পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, যা মহাসাগরীয় জনগনের সাথে কো- এনসেস্ট্রাল বা সমপূর্বপুরুষীয়। রাইখ এট আল.এর মতে,” আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীগণ এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান দলের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু এদের মধ্যে কোনো এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান উপাদান নেই।
আরও পড়ুন- ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন কেমন ছিল?