১৯৭০ সালের ভোলা  ঘূর্ণিঝড়ঃ বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানা সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড়

১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে, যেটি ভোলা  ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রবল গতিবেগে এই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। উল্লেখযোগ্য ঝড় গুলোর মধ্যে ভয়ংকরতম ও তীব্র গতিবেগ সম্পন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল এই ভোলা ঘূর্ণিঝড়।

উৎপত্তিস্থল: ভোলা ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়ে ক্রমাগত তীব্র গতিবেগ নিয়ে অধীক শক্তিশালী হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। ১১ই নভেম্বর এর গতিবেগ দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার (১১৫ মাইল) এবং ১১ই নভেম্বর রাতেই ভোলা ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় অঞ্চল ও সমতল ভূমি পানিতে প্লাবিত হয়। এই জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা ছিল ১০ থেকে ৩৩ ফুট। এই ভোলা ঘূর্ণিঝড় কে “দ্যা গ্রেট ভোলা সাইক্লোন” নামে ডাকা হয়।

ক্ষতির পরিমাণ: ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কিত কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। তবে ধারণা করা হয় তিন থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। এছাড়াও মারা গিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ গবাদিপশু। বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, প্রায় ৩৫০০ শিক্ষাকেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৮৬.৪ মিলিয়ন ডলার।

ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল : সে সময়ে উপকূলীয় সকল অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চট্টগ্রাম, বরগুনা, পটুয়াখালী, চর তাজুমুদ্দিন এর  মাইজদি, বোরহান উদ্দিনের উত্তর পাশ এবং হরিণ ঘাটের দক্ষিণ পাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০৫ কিলোমিটার ঘন্টা গতিবেগে ভোলা ঘূর্ণিঝড় উপকূলে অঞ্চলকে ধ্বংসবাশেষে এ পরিণত করে।

ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা : ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২০৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় এবং সর্বনিম্ন গতিবেগ ছিল ১৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। পরিসংখ্যান মতে, ২০৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় এক মিনিট। ১৮৫ কিলোমিটার গতি বেগের স্থায়িত্বকাল তিন মিনিট। এই ঘূর্ণিঝড়কে উত্তর ভারতীয় শক্তিশালী ঝড়ের মধ্যে ষষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সিম্পসন স্কেলে ছিল তৃতীয়। ১০ থেকে ৩৩ ফুট  উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে উপকূলীয় অঞ্চলে।

সরকারের ব্যর্থতা : তৎকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিল ইয়াহিয়া খান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে তেমন বিচলিত ছিলেন না। তাই যথাযথ ত্রাণ ও পুনর্বাসন সুবিধা সাধারণ মানুষ ঠিকভাবে পায় নি। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নতুন করে শুরু হয়েছিল মৃত্যু মিছিল। ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ৭ দিন পর ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে, ঘূর্ণিঝড়ের  ভয়াবহতা বুঝতে না পেরে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন : ঘূর্ণিঝড়ে অসহায় মানুষের প্রতি পাকিস্তানি সরকারের নেতিবাচক মনোভাব দেখে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২৪শে নভেম্বর ১৯৭০ সালে মাওলানা ভাসানী ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলার স্বাধীনতার অন্যতম কারণ বা হাতে খড়ি হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুন- বাংলাদেশে আঘাত হানা বিধ্বংসী যত ঘূর্ণিঝড়