মধ্য পৃথিবীর ধারণা

মধ্য পৃথিবীর ধারণা

  • বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের অনেক আগেই তৎকালীন পৃথিবীতে দুটো ভিন্ন ধরনের পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। আটলান্টিক মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী অববাহিকায় এই পৃথিবীর অবস্থান। দুটো ভিন্ন ধারার পৃথিবীর ভ্রমণ ও বাণিজ্য পথগুলোও ছিলো ভিন্ন ভিন্ন। এক পৃথিবীতে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো মূলত সমুদ্রপথ আর অন্যটি ছিলো স্থলপথ।
  • যদি কেউ প্রাচীন সময়ের সমুদ্রপথটি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখবেন যে বাস্তবিক অর্থে বিশ্ব ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র ছিলো ভূমধ্যসাগর। কারণ, ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করেই অতীতের মাইসেনাইয়ান,ক্রিটান,ফোয়েনিসিয়ান,লিডিয়ান গ্রিক বা রোমানদের মতো প্রসিদ্ধ জাতিগুলো  আর তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত  হয়েছিলো। সেই সময়ে যারা ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে থাকতো তারা খুব সহজেই এই অঞ্চলে  থাকা অন্যান্য জাতি -উপজাতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা তথ্য বিনিময় করতে পারতো। তাই  বিশাল সমুদ্র উপত্যকা ক্রমান্বয়ে বৈচিত্র্যময় মানুষের মিলনস্থলে পরিণত হয়। সেই  সঙ্গে তারা তাদের নিজেদের মতো করে কাহিনী রচনা ও প্রচার করার কারণে ঘটনাবহুল এবং বৈচিত্র্যময় ঐতিহাসিক উপাখ্যান ও রচিত হয়। আজকের পশ্চিমা সভ্যতা মূলত সেই ইতিহাসেরই একটি  পরিণতি।
  • এবার তিনি যদি আরেকটি ধারার দিকে তাকান দেখবেন যে  স্থলপথই ছিলো সে ধারার যোগাযোগের মাধ্যম।
  • ভারতীয় উপমহাদেশ,মধ্য -এশিয়া,ইরানের সুউচ্চ ভূমি, মেসোপটেমিয়া এবং মিশরের এলাকার সাথে সংযুক্ত সড়কগুলো এ যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। এই এলাকায় অনেক নদী ও সাগরের অবস্থান ও ছিলো। যেমন: এখানে ছিলো পারস্য উপসাগর ইন্দু (সিন্ধু ) ও অক্সাস নদী, অ্যারাল ও কাস্পিয়ান সাগর, ভূমধ্যসাগর, ব্ল্যাক সি, নীলনদ এবং লোহিত সাগর। মূলত এ অঞ্চলকে ঘিরেই মুসলিম বিশ্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়। (এখানে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বা সাম্রাজ্য বলতে আজকের ইউরোপ এবং মধ্য পৃথিবী বলতে আজকের মুসলিম বিশ্বকে বোঝানো হয়েছে)। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মুসলিম বিশ্বের এই এলাকাগুলোকে আলাদা করে কোন নামকরন করা হয়নি, উপরোক্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি অংশকে মধ্যপ্রাচ্য হিসেবে অভিহিত করা হলেও তার নামকরণের কারণটি বেশ দুর্বোধ্য। ধরুন, মধ্যপ্রাচ্য বা প্রাচ্যের মাঝখানে শুনলে মনে হয় কেউ পশ্চিম ইউরোপের বিপরীতে কোনো স্থানে আছেন। আবার, ধরুন কেউ পারস্য উচ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন যে আমি এখন কোথায়? তাহলে বিশ্বের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী তিনি আসলে মধ্য পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছেন অথচ মজার ব্যাপার হলো জায়গাটির নাম আসলে মধ্যপ্রাচ্য। আর নাম নিয়ে এরূপ বিভ্রান্তির কারণেই মধ্যপ্রাচ্য না বলে ইন্দুস বা সিন্ধু নদী থেকে শুরু করে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত গোটা এলাকাটিকে ‘মধ্য পৃথিবী’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এরকম নামকরণের কারণ হলো আসলে এই এলাকাটি ভূমধ্যসাগরীয় সাম্রাজ্য এবং চৈনিক সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি একটি জায়গায় অবস্থিত। তাই একে মধ্য পৃথিবী বললেই বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে।

চৈনিক পৃথিবীর একটি আলাদা জগৎ ছিলো যা উপরোক্ত বড়ো দুই জগতের তুলনায় পুরোপুরি আলাদা। চীন ভৌগোলিকভাবে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার হিসেবে থেকে দূরত্বের কারণে বাদ পড়ে গেলো। আর মধ্য পৃথিবী থেকে চীন আলাদা হয়ে পড়লো হিমালয়, গোবি মরুভূমি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন বনাঞ্চলের কারণে। এসব প্রাকৃতিক সীমানা প্রাচীরের কারণেই চীন এবং তার নিকটস্থ বন্ধু ও বিদ্রোহীরা একটু দূরে দূরে থাকতো। আর ঠিক সে কারণেই মধ্য পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা চৈনিক উপাদানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। তাই এখানে চাইনিজদের নিয়ে কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই কম। আবার একইভাবে কম আলোচনা হচ্ছে সাব- সাহারা আফ্রিকানদের নিয়েও। সাহারা মরুভূমির কারণে এই গোটা সাব সাহারা অঞ্চলটিও ইউরোপ বা এশিয়া  থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন হয়েই থেকেছে। আবার  ভৌগলিকভাবে ভিন্নতার কারণে আমেরিকাও মোটামুটি ইউরোপ বা এশিয়ার বলয়ের  বাইরে থেকে নিজেদের মতো করে একটি পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছিলো। একইসঙ্গে তারা নিজেদের মতো করে একটি নিজস্ব ইতিহাসও তৈরি করেছে।

অবশ্য ভৌগোলিক অবস্থানগত এই ভিন্নতা চীন বা আমেরিকাকে যতোই বিচ্ছিন্ন করুক না কেন, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বা মধ্য পৃথিবীর মধ্যে কখনোই এমন কোনো বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।

এই দুটো অঞ্চল তাদের মতো করে যে দুটো আলাদা পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছিলো তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ফিলিপ ডি কার্টিন বলেছেন এই দুই অঞ্চলের ভিন্নতার আসল কারণ হলো আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা। এই দুই অঞ্চল একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার চেয়ে নিজেদের এলাকার ভিতরে যোগাযোগ রক্ষা করাটাকেই বেশি গুরুত্বারোপ করতো। কার,  সেটাই সহজ ছিলো। ভূমধ্যসাগরীয় কোনো উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগরের অন্য কোনো উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায় যাওয়া খুবই সহজ ছিলো। সেই তুলনায় ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে ইন্দুস (সিন্ধু) নদী তীরবর্তী এলাকায় যাওয়া বেশ কঠিন। অপরদিকে, সেই প্রাচীনকাল থেকে মধ্য পৃথিবীতে যে সকল বণিক আসা-যাওয়া করতেন, বিশেষ করে ক্যারাভান নিয়ে যারা যাতায়াত করতেন, তারা যেকোনো সময়ে যেকোনো দিকে বাঁক নিতে পারতেন। তাদের কাছে এই এলাকাটি বেশ পরিচিত ছিলো তারা সর্বদা পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হতেন। এই পথে যেতে যেতে যখন তারা এশিয়ার মাইনর অঞ্চলের (বর্তমান তুরস্ক) কাছাকাছি আসতেন, তখন একটা পর্যায়ে বসফরাস প্রণালীর নিকটে এসে পথটা অনেকটাই সরু হয়ে যেতো। আর এরও পরে  বিশাল সাগর থাকায় তারা আর অগ্রসর না হয়ে আবার  কেন্দ্রের দিকে ফিরে আসতেন অথবা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয়  এলাকা ধরে অগ্রসর হতেন।

আর এভাবেই ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্য পৃথিবীর ইতিহাসগুলো রচিত হয়েছে। যারা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় বসবাস করতেন তাদের এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিলো যে, তারাই আসলে মানব ইতিহাসের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছিলেন। অন্যদিকে, যারা মধ্য পৃথিবীর অধিবাসী তারাও যৌক্তিকভাবেই ভেবে নিতে পারেন যে তারা পৃথিবীর একেবারে মূল কেন্দ্রেই থাকতে পেরেছেন।

এই দুই ভিন্ন পৃথিবীর ইতিহাস বারবার একটি অন্যটির মধ্যে ঢুকে গেছে। কখনোবা অতিক্রম করে গেছে বেশ কিছু জায়গায়। মজার ব্যাপার হলো,আজ এতো বছর পরে এসেও আমরা সেই জায়গাগুলোকেই সবচেয়ে অস্থির অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। আর এক্ষেত্রে ইসরাইল, লেবান,  জর্ডান,  সিরিয়া প্রভৃতি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *