বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বীরত্ব
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য যারা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন,দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। যিনি অসীম সাহসিতকা এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানুষের মাঝে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। আজ আমরা মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সম্পর্কে জানব।
জন্ম ও পরিচয়:
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলায়র রহিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ছিলেন কৃষক এবং মা সাফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী।দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় মহিউদ্দিনের। তারা তিন বোন ও তিন ভাই। দাদা আব্দুর রহিম হাওলাদার ছিলেন প্রতাপশালী ব্যক্তি। পিতার আর্থিক দৈন্যতার কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মামার বাড়ি মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে যান মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
শিক্ষা জীবন:
মামা বাড়িতে যাওয়ার পরে সেখানেই শুরু হয় তার পড়াশোনা জীবন। প্রথমে তিনি পাতারচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে ভর্তি হন । প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মহিউদ্দিন ভর্তি হন মাহমুদ জান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মহিউদ্দিন ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতিও করেছেন। পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের লেখকদের বইও পড়তেন। উচ্চ মাধ্যমিকের পর বিমানবাহিনীতে যোগদান করার চেষ্টা করলেও মহিউদ্দিনের চোখের সমস্যার জন্য স্বপ্ন পুরন করতে পারেনি। এখানেই শেষ হয়ে যায়নি তার জীবন। এরপর তিনি নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন। এরপর তিনি পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে ২ জুন ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তার নাম্বার ছিলো PSS-10439.
মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ভুমিকা:
১৯৭১ সালে শুরু হয়েছিলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই সময় মহিউদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানী ব্যাটেলিয়নে। পাকিস্তান চীন সংযোগকারী মহাসড়ক নির্মানে কর্তব্যরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হয়েছে জানার সাথে সাথেই মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সঙ্গে করে একটি পিস্তল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। ১০ জুন তিনি কয়েকদিন এর ছুটি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রিসালপুর যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও সীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি বিএসএফ ব্যাটলিয়ন হেড কোয়াটারে যান। সেখান থেকে দিল্লি পরে কলকাতা যান।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা চারজন বাঙালি পালিয়ে এসেছেন জানার পরে সবার মনেই আনন্দ অনুভব হলো। তারা একসাথে যুদ্ধ করবে দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য। চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন এই বীরসেনাদের স্বাগত জানাতে। এরপরে তিনি বাংলাদেশে আসেন কিন্তু তিনজন সহযোগী আসতে পারেননি। তিনি তাদের কথা ভাবা বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদিপুর মুক্তিবাহিনীর ৭ নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন। এখানে সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হকের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। আক্রমন প্রবল হওয়ায় একবার একটি শত্রু লাইনের উপর হামলা চালাবার পূর্ব মূহুর্তে প্রায় সহস্রাধিক শত্রুসেনা পালিয়ে যায়। মহিউদ্দিনের সাহসিকতা আর মেধার জন্য তাকে পাঠানো হয় রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য অনুমতি দেন সেক্টর কমান্ডার নুরুজ্জামান। তিনি তিনটি দলে ভাগ করে দেন। তৃতীয় দলের দায়িত্ব দেন মহিউদ্দিনকে।১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ৫০ জন যোদ্ধা নিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১১ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর গোলাবর্ষন করার কথা থাকলেও তারা সেটি করেনি। এরপর ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে যখন ব্যর্থ হয় তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনী ছাড়াই তিনি তার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করবেন । এরপর তিনি যুদ্ধ শুরু করেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিজয় নিশ্চিত করেই শহীদ হয়েছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
যেভাবে শহীদ হলেন:
১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম,লেফটেন্যান্ট আউয়াল ও ৫০ জনের মতো যোদ্ধা চাপাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়া এলাকায় অবস্থান করেন। ১৪ ডিসেম্বর ২০ জন যোদ্ধা নিয়েই বাঘরিয়া একালা থেকে ৪/৫ টি নৌকা নিয়ে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করে যাওয়ার পরে উওর দিকে তিনি প্রত্যেকটি শরুর অবস্থান নির্নয় করে তারা সেইভাবে যোদ্ধা সাজিয়ে নেন এবং দক্ষিণ দিকে এগোতে থাকেন।এমন পরিকল্পনা করার পরে সব রাস্তা আটকে দেন শত্রুদের যেন তারা বুজতে না পারে। বিজয় নিশ্চিত জেনেই সামনে এগিয়ে যায় তারা। কিন্তু বিপদ হঠাৎ করেই আসে। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মাড ফোর্সের ১০/১২ জন মিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। যখন একটি মাত্র শত্রুর অবস্থান বাকি রইল ঠিক তখন মুখোমুখি বাংকার চার্জে শত্রুর বুলেটে এসে বিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
সমাধিস্থল :
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ সোনা মসদিজ প্রাঙ্গনে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানেই সমাহিত করা হয়।
সম্মাননা:
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীর শ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে। বরিশালের নিজ গ্রামের নাম তার দাদার নামে হওয়ায় পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছে অনুসারে তার ইউনিয়নের নাম ‘আগরপুর’ পরিবর্তন করে ‘মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর’ ইউনিয়ন করা হয়েছে৷ সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল জেলা পরিষদ ৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বীর শ্রেষ্ঠের পরিবারের দান করা ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মাণ করছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার৷ স্বরূপনগরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের নাম তার নাম অনুসারে রাখা হয়েছে। ঝালকাঠি জেলা স্টেডিয়ামের নাম এই বীর শ্রেষ্ঠের নামে নামকরণ করা হয়
হাজার মানুষের আবেগ ভালবাসা জড়িত আছে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সাথে। এতটুকু বয়সে তিনি তার মেধা দিয়ে যে পরিকল্পনা সংগ্রাম করেছেন তার তুলনা হয় না। অমর হয়ে আছেন দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে।