মিং সাম্রাজ্য এবং চীনের মহাপ্রাচীরের ইতিকথা

সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিচারে চীন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ এক ভৌগলিক অঞ্চল। শুধু প্রাচীন নয়, বিশালও বটে। খ্রিস্টের জন্মের বহুকাল আগে থেকেই চীন ভৌগলিকভাবে মানচিত্রের বেশ বড়সড় একটা জায়গা দখল করে রেখেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসে চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। উত্তর আধুনিক কালে চীনের এমন শক্ত অবস্থানের ভিত গড়ে দিয়েছিল মিং রাজবংশ।

১৩৬৮ সাল থেকে ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিনশো বছর ধরে চীন শাসন করে মিং পরিবার। তাদের শাসনামলে পৌনে তিনশো বছরেই চীনের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। মিং রাজাদের প্রত্যক্ষ ইচ্ছাতেই চীন বহির্বিশ্বর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিস্তার করে। পাশপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন চীনের সামনে বাণিজ্যের এক বিশাল দোয়ার উন্মোচন করে দিয়েছিল। মিং শাসনামলে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চীনে নাটক এবং সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধি লাভ করে। বাণিজ্যিকভাবে বিশ্ববিখ্যাত চীনা মাটির আসবাব তৈরি এবং বহির্বিশ্বে রপ্তানির প্রসারও ঘটে এই সময়টাতেই।

মিং সাম্রাজ্যের উত্থান

মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সম্রাট তাইজু বা ঝু ইউয়ানজ্যাং অতিদরিদ্র এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চীনের ইয়েলো নদীর চারপাশে একাধিক প্রাকৃতিক দূর্যোগ হানা দিলে অল্প বয়সেই তাইজু তার পিতা-মাতাকে হারান। এরপর তার যৌবনের বেশ খানিকটা সময় তিনি চীনের বিভিন্ন এলাকায় ভবঘুরের মতো ঘোরাফেরা করেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।

এভাবে বেশ কয়েক বছর ঘোরাফেরা করার পর তিনি একটা বৌদ্ধ বিহারে এসে আশ্রয় নেন। তিনি এবং তাঁর সাথে আরও কয়েকজন বৌদ্ধ বিহারের জন্য ভিক্ষা করেই নিজেদের পেট চালাতেন। মোটামুটি শান্তিতেই কাটছিলো দিন। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগার কপালে সুখ সয় না। আভ্যন্তরীণ এক বিদ্রোহ চলাকালে সৈন্যরা এই বৌদ্ধ বিহারটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। তাইজু আবারও ভবঘুরে হয়ে যান।

কিছুদিন এখানে ওখানে ঘোরাফেরা করার পর ১৩৫২ সালে তিনি লোটাস সোসাইটি সমর্থিত এক বিদ্রোহী দলে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে ফেলার ক্ষোভ থেকেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। তার নিরলস চেষ্টা আর অনুশীলনের ফল হিসেবে অল্প সময়ের ব্যবধানেই সাধারণ সৈনিক থেকে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা হয়ে যান তিনি। নানজিং শহরে আগ্রাসী আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার পর চারদিকে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, তখনকার শাসকদের জন্য এই শহর খুব গুরুত্ব পূর্ণ একটি ঘাঁটি ছিলো।

মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সম্রাট তাইজু বা ঝু ইউয়ানজ্যাং
মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সম্রাট তাইজু বা ঝু ইউয়ানজ্যাং

এরপর বেইজিং এর সিংহাসন থেকে মঙ্গোলিয়ান শাসকদের বিতাড়িত করে বেইজিং নিজের দখলে আনার জন্য নিজের শক্তি সামর্থ্য বাড়াতে থাকেন তাইজু। তখন বেইজিংসহ চীনের বিশাল একটা অংশের দখল ছিলো মঙ্গোলিয়ান ইউয়ান সাম্রাজ্যের হাতে।

দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ১৩৬৮ সালে তাইজু তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে বেইজিং আক্রমণ করে বসেন। তাঁর আগ্রাসী আক্রমণে মঙ্গোলিয়ান শাসকরা শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। বেইজিং-এ মঙ্গোলিয়ানদের চিহ্ন চিরতরে মুছে দিতে প্রাসাদগুলোও গুড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বেইজিং-এর সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি মিং সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘোষণা দেন।

সম্রাট তাইজুর সেনাবাহিনীর সামরিক শৃঙ্খলা ছিলো অনন্য। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে এটা অন্যতম একটা কারণ। তাঁর সামনে মাথানত করাটা ছিলো একরকম প্রায় বাধ্যতামূলক। কেউ মাথানথ না করলে তাকে বেধড়ক পেটানো হত, এমনকি কারাবাসও করতে হতো সেই লোককে।

শাসনকার্যে তাইজুর বিচক্ষণতা মুগ্ধ করার মতো। ষড়যন্ত্রকারী এবং বিশ্বাসঘাতকদের চিহ্নিত করতে তিনি তাঁর প্রাসাদের এক সাধারণ রক্ষীকে গোপন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁর এই গোপন তদন্ত কার্য প্রায় ১৪ বছর স্থায়ী ছিলো। এবং এই সময়ে প্রায় ৩০ হাজার বিশ্বাসঘাতক এবং ষড়যন্ত্রকারীকে নরকের দুয়ারে পাঠিয়েছিলেন তিনি।

তবে তাঁর এরকম বিচক্ষণতা নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকেই ধারণা করেন, এটা নেহায়েত মস্তিষ্ক বিকৃতির ফল। কারণ এরকম আরও দুটি গোপন তদন্ত চালিয়ে তিনি প্রায় ৭০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন। যাদের মধ্যে উচ্চ পদস্থ রাজকীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রহরী এমনকি অতি সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত ছিলো।

মিং সাম্রাজ্যের বাণিজ্য বিস্তার

তাইজু মারা যাওয়ার আগে তাঁর ১৫ বছর বয়স্ক এক নাতিকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করেন। কিন্তু সে সিংহাসনে বসার পর তাইজুর পুত্র চেংজু বিদ্রোহ করে বসে এবং মিং সাম্রাজ্যে এক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ফলাফল স্বরূপ তাইজুর সেই নাতিকে সরিয়ে সিংহাসনে বসেন চেংজু।

শাসক হিসেবে চেংজু ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ নীতির অধিকারী। বিশ্বজুড়ে মিং সাম্রাজ্যের পরিচিতি আনতে এবং চৈনিক সভ্যতার সাথে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিতে ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত, পারস্য উপসাগর এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে বহু জাহাজ প্রেরণ করেন। একই উদ্দেশ্য নিয়ে ইউরোপেও যাত্রা করেছিল মিং সাম্রাজ্যের পতাকাবাহী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ। এসব জাহাজ যাত্রার পেছনে অবশ্য অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো। সেটা হলো বাণিজ্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪৫৭ সাল থেকে মিং সাম্রাজ্যের অধীনে বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপে জাহাজ যাত্রা শুরু করে চীনারা। ইউরোপে মূলত তারা রেশম রফতানি করতো। এদিকে ইউরোপ এবং চীনের মধ্যকার সামুদ্রিক পথ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় চীনে ধীরে ধীরে ইউরোপিয়ানদের আগমন ঘটতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এই সময়টাতেই চীনারা প্রথমবারের মতো চীনা বাদাম এবং মিষ্টি আলুর সাথে পরিচিত হয়। ইউরোপিয়ান বণিকরা নিয়ে এসেছিলো এগুলো।

মিং সাম্রাজ্যের দখলে থাকা অঞ্চল
মিং সাম্রাজ্যের দখলে থাকা অঞ্চল

চীনামাটির আসবাবপত্র

মিং সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান রপফতানি পণয় ছিলো চীনামাটির আসবাবপত্র। বাহারি এই জিনিসের সাথে বিশ্বকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলো মিংরাই। চীনাপাথরের সাথে চীনামাটির সংমিশ্রণকে একদম স্বচ্ছ আকার ধারণ করার আগ পর্যন্ত উত্তপ্ত করে তারপর সেগুলো দিয়ে নানান আকারের বাহারি আসবাব তৈরি করতো চীনারা। এই পদ্ধতিটি বেশ পুরাতন হলেও মিং শাসনামলেই এর বহুল উৎপাদন শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে এর চাহিদা ছিল ব্যাপক, বিশেষ করে ইউরোপে। উল্লেখ্য যে, ১৩৬৮ সালে জিঙ্গদেহেনে মিংদের অধীনে চীনামাটির আসবাব তৈরি জন্য একটি রাজকীয় কারখানা চালু করা হয়েছিল। রাজবংশের লোকদের এবং বন্ধু সাম্রাজ্যের রাজাদে উপহার দেওয়ার জন্য বিশেষ যত্ন নিয়ে তৈরি করা হতো চীনামাটির আসবাব। মিংদের আসবাবের রাজকীয় রঙ ছিলো নীল এবং সাদা।

চীনের মহাপ্রাচীর

চীনের মহাপ্রাচীর রক্ষাণাবেক্ষণে চীনের রাজবংশগুলোর ভূমিকা কখনোই ধারাবাহিক ছিলো না। এ কারণে এক রকম প্রায় অযত্ন অবহেলাতেই ছিলো চীনের এই মহাপ্রাচীর। মিং শাসনামলে এই প্রাচীরে সবচেয়ে বেশি সংস্কার প্রয়োজন ছিলো।

মঙ্গোলীয়দের সব সময়ই মিং সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতো। চীনের মহাপ্রাচীর অতন্দ্র প্রহরীর মতো মিং এবং মঙ্গোলিয়ানদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলো। মঙ্গোলীয়দের আক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষাই ছিলো এই প্রাচীর। কিন্তু প্রাচীরের দীর্ঘদিন প্রাচীরের সংস্কার না হওয়ায় দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে মঙ্গোলরা বেশ কয়েক দফা মিং সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালায়। কয়েক দফা সংঘর্ষের পর ১৪৪৯ সালে তারা তৎকালীন সম্রাট ঝেং টেংকে অপহরণ করতে সক্ষম হয়।

মিং সরকার তখন সম্রাটকে ফেরত পেতে মুক্তিপণের বদলে ভিন্ন এক পন্থা অনুসরণ করে। মঙ্গোলিয়ানরাও এতে রাজি হয়ে যায়। সম্রাটের এক সৎ ভাইয়ের বদলে তারা সম্রাটকে ফিরিয়ে দেয়।এরপর তিনি নাম পরিবর্তন করে তিয়াংশুন নামে পুনরায় সিংহাসনে বসেন।মূলত এরপরই মিং সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থা আরো পাকাপোক্ত করতে মহাপ্রাচীর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মিং সাম্রাজ্যে খ্রীস্টানদের অভ্যুত্থান

ইউরোপের সাথে চীনের যোগাযোগ নিয়মিত হয়ে যাওয়ার পর থেকে খ্রিস্টান মিশনারিরার এই দেশে নিজেদের অস্ত্বিত্ব জানান দিতে শুরু করে। ১৫৮৩ সালে মাত্তিও রিকি নামক একজন পাদ্রী চীনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ক্যাথলিক মিশন শুরু করেন। সেই লক্ষ্যে তিনি একটি ক্যাথলিক চার্চও নির্মাণ করেছিলেন। চীনা ভাষায় মাত্তিওর দক্ষতা ছিলো বেশ। তিনি লাতিন ভাষায় চীনা সাহিত্যগুলো অনুবাদ করে তা ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। লাতিন ভাষায় চীন এবং মিং সাম্রাজ্য নিয়ে তাঁর নিজের লেখা একাধিক বইও আছে। এছাড়াও তিনি পশ্চিমা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই চীনা ভাষাতেও অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদ করা ইউক্লিডের বইগুলো চীনজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মাত্তিও চীনে এসে পুরোদস্তুর চৈনিক বনে গিয়েছিলেন। সম্ভ্রান্ত চৈনিকদের মতো সবসময় সিল্কের পোষাক পড়তেন তিনি। এমনকি নিজের নাম পালটে তিনি চীনের সাথে মিল রেখে লি মাতু রেখেছিলেন।

মিং শাসনামলে সাহিত্য

মিং শাসনামলে চীনজুড়ে অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠে। এসব প্রকাশনা সাশ্রয়ী মূল্যে বই ছাপিয়ে জনসাধারণের কাছে বিক্রি করতো। রেফারেন্স বইয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় বই, পাঠ্যপুস্তক এবং কনফুসিয়াস সাহিত্যের বইগুলোর ব্যাপক চাহিদা ছিলো তখন। এছাড়া তখন চীনে সিভিল সার্ভিসে অংশগ্রহণের জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। এসব পরীক্ষার নানা রকম গাইড বই ও বিক্রি হতো দেদারসে।

গোটা মিং সাম্রাজ্য জুড়ে তখন কথাসাহিত্যের বিশাল একটা বাজার ছিলো। বিশেষ করে চলিত চীনা ভাষায় লেখা গল্পের। বিখ্যাত চীনা লেখক ফেং মেনগ্লংয়ের একটা জনপ্রিয় ধারাবাহিক রম্য সিরিজ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলো।

মিং শাসনামলে চীনে সাহিত্য চর্চা বিস্তার লাভ করে
মিং শাসনামলে চীনে সাহিত্য চর্চা বিস্তার লাভ করে

এছাড়াও নাটকের পান্ডুলিপিও বিক্রি হতো দেদারসে। তখনকার বিখ্যাত নাট্যকার তাং জিয়াংজুর লেখা নাটকগুলো ছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সামাজিক নানা বৈষ্ম্য নিয়ে বিদ্রূপ এবং রোমান্সের মিশেলে লেখা তাঁর নাটকগুলো সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ ছিলো।

চীনে পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাসের বিকাশ ঘটে মূলত মিং শাসনামলেই। চীনের বহু শতাব্দীর ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো বিভিন্ন ভাষাতে অনুবাদও হতো। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনা করা অনেক লেখক আবার ছদ্মনামে লেখতেন।

এই সময়টাতে বইয়ে চিত্র বা ছবির ব্যবহার বিকাশ লাভ করেছিল। চীনাদের আবিষ্কৃত নব্য মূদ্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজেই লেখার পাশাপাশি চিত্রগুলো ছাপানো যেতো বইয়ে। ফলে সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখাগুলো আরও সহজবোধ্য হয়ে উঠতো। আর এর ফলে নতুন পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিলো উল্লেখযোগ্য হারে।

মিং সাম্রাজ্যের পতন

মিং সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো অর্থনৈতিক সমস্যা। শেষের দিকে এসে ভীষণ রকম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলো মিংরা। রাজকীয় পদে আসিন ছিলো অসংখ্য কর্মচারী। যতো জন না দরকার ছিল তাঁর চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বেশি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার খেসারতটা বেশ চড়া দামে দিতে হয়েছিলো মিংদের।

এছাড়াও সামরিক খাতে মিং সাম্রাজ্যের ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো আকাশচুম্বী। তাঁর উপর জাপান এবং কোরিয়া আক্রমণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজকোষ ছাড়া হয়েছিলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। পরাজিত হয় মিংরা। মিং সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় শত্রু মঙ্গোলীয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাখাতেও রাজকোষ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হতো।

একে তো বিশাল খরচার ভার তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খাজনা আদায় করতে না পারায় রাজকোষের উপর চাপ আরও বেড়ে যায়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা সৈন্যরা মিং সেনাদের সুংশৃঙ্খলা নীতি পরিহার করে পালিয়ে গিয়ে সংগবদ্ধ হয়ে লুটতরাজ চালাতে থাকে। দিনকে দিন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় গোটা মিং সাম্রাজ্য জুড়ে।

পালিয়ে সংগঠিত হওয়া এসব সেনারা দল বেঁধে পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রাজকীয় সামরিক বাহিনী তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। শহরের পর শহর লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে এসব সেনারা। এর পরপরই বন্যা, খরা, পঙ্গপাল এবং মহামারী রোগের সংক্রমণ সাম্রাজ্যটিকে নাজেহাল করে ফেলে।

১৬৪২ সালের একদল বিদ্রোহী সেনা ইয়েলো রিভারের একটি বাঁধ ভেঙে ফেললে ঐ অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায়, গৃহহীন হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ।

১৬৪২ সালে গুটিবসন্ত নতুন করে মহামারী আকার ধারণ করলে এক সময় সুশৃঙ্খলতার জন্য প্রশংসার দাবিদার এই সাম্রাজ্যের সামাজিক শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে যায়। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় প্রতিযোগী দুই বিদ্রোহী নেতা লি জিচেং এবং ঝাং। তারা মিং সাম্রাজ্যের পৃথক দুটি অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে উভয়ই আলাদা রাজবংশের সূচনা করে।

১৬৪৪ সালে সাম্রাজ্যের এমন অসহায় পতন দেখে দুঃখে আত্মহত্যা করে বসেন সর্বশেষ মিং সম্রাট চংঝেন। আর এরই সাথে মিং সাম্রাজ্য ইতি টানে ইতিহাসে।

আরও পড়ুন- মায়া সভ্যতা বা মায়ান সাম্রাজ্যের ইতিহাস

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *