বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফার ভূমিকা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি মহান স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা ও উনসত্তের গণঅভ্যুত্থানের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ভাষা আন্দোলন
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন তীব্রভাবে শুরু হলেও এর সূএপাত হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু কেউ কল্পনাও করেনি এর প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল এত সূদুরপ্রসারী হবে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিওিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়। ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান কোন অখণ্ড ভূখণ্ড পায় নি। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ- পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় ২ হাজার কিলোমিটারের দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান আধিরাজ্য সরকার পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবীকরনের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলার মানুষ এসব মেনে নিতে পারেনি বলেই দ্রুত আন্দোলনের দানা বেঁধে যায়। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসলে পুশিল মিছিলরত ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেখানে নিহত হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরও অনেকে। এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। ২৪শে ফেব্রুয়ারী শহীদ শফিউরের পিতা শহীদ মিনার উদ্ভোদন করেন।
গণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বকৃীত দেয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক ও ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক পট পরিবর্তন হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামীলীগের বৃহওর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাশালী মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনের আগেই বহুসংখ্যক নেতাকে তারা গ্রেফতার করে এবং তারা যেন জয়ী না হতে পারে তার সব রকমের ব্যবস্থা নেয় মুসলিম লীগ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি সমাবেশে বলেন যে, বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করা হবে। এমন সিদ্ধান্তে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তীব্র নিন্দা জানান। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নিয়ে মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করেন।
১৯৫৬ সালে প্রথম বারের মতো পাকিস্তান সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে এটি স্মরনীয় হয়ে থাকবে সারাজীবন।
ছয় দফা
ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যকার বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক শাসনের অবসানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঘোষিত কর্মসূচি। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার বেশ উদাসীন হয়ে ওঠে। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতারা তাসখন্ড উওর ও রাজনীতির ধারা বজায় রাখার জন্য ১৯৬৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারী এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নেতাকর্মীদের নিয়ে লাহোরে পৌঁছান। পরদিন সভায় তিনি ‘ছয়দফা দাবি’ পেশ করেন। কিন্তু মুজিবের এ দাবী কেউ গ্রহণ করেন নি। তাই শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারী সম্মেলন বর্জন করেন।
১৯৬৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের এক সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং এই দাবী আদায়ের লক্ষে আন্দোলন কর্মসূচি গৃহিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ এর নেতৃত্বে ছয়দফা দাবির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের এক অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।
৬ দফা দাবিগুলো নিম্নরূপ:
১| লাহোর প্রস্তাবের ভিওিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।
২| ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয় প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক। অপর সব বিষয় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের কাছে থাকবে।
৩| পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আলাদা দুটি মুদ্রা থাকবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি মুদ্রাই সচল থাকবে। একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পূজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪| দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে।
৫| দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন ধার্য শুল্ক আদায় করা হবেনা এবং রাজ্যগুলো যাতে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬| প্রতিরক্ষার পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষে আধা সামরিক রক্ষা বাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ ছয় দফা দাবি কেউ মেনে নেয়নি। আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং যড়যন্ত্র করে তাকে আগরতলা মামলায় ফাসিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়। এ মামলার বিরুদ্ধে সারা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৭০ এর নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে জয়লাভ করে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বিলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের সাথে সাথে প্রদেশিক নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮ টি আসনের ৮১টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের বিজয়ই বাঙালিকে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টির সাহস ও প্রেরণা যোগায়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।রাজপথে রক্ত দিতে হয়েছে। তবুও এদেশের মুক্তিকামী সাধারণ জনগণ থেমে থাকেনি। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাগ্রত হয়েছিলো সর্বস্তরের জনগণ।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশ করেন। সেখানে তিনি ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ দেন। মানুষকে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শএুর মোকাবিলা করো”। তিনি আরও বলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। মানুষের মনের ইচ্ছে শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি এই জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য ১১ টি সেক্টরে সমগ্র বাংলাদেশকে বিভক্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন- জাফরুল্লাহ চৌধুরীঃ একজন নির্ভীক, সৎ, ক্ষ্যাপাটে দেশপ্রেমিক