বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল

স্বাধীন বাংলার স্বাধীন মানুষ আমরা। নিজেদেরকে স্বাধীন  করার জন্য দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। বাংলার বীর সন্তানেরা দেশপ্রেমে উদ্ভুত হয়ে নিজেদেরকে এবং অন্যদের যুদ্ধে অংশ গ্রহন করার অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে।ধনী,গরীব,ছাত্র,শিক্ষক, কৃষক,শ্রমিক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। সাহসিকতা আর শরীরের তাজা রক্ত দিয়ে তাঁরা প্রমান করে দিয়েছে দেশের জন্য তারা শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তারা তাদের অধিকার রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন ও দিতে পারেন।  তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। যার সাহসিকতা আর ত্যাগের বিনিময় আমারা পেয়েছি স্বাধীনতা। আমরা আজকে জানব বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল সম্পর্কে।

জন্ম ও পরিচয়:

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানায় পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ছিলেন। তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। কিভাবে নিজেকে মানুষের কাছে উপস্থাপন করা যায় সেই নিয়ে ভাবতেন।

শিক্ষা জীবনে মোস্তফা কামাল:

প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে দু এক বছর পড়াশোনার পরে তিনি আর কোন পড়াশোনা করেননি। তার বাবা সেনাবাহিনীর হাবিলদার হওয়ার তার স্বপ্ন হয় সেও একজন সেনাবাহিনীর সদস্য হবেন। তার বাবার সেনানিবাসে থাকার কারনে সেখানকার কুচকাওয়াজ,মার্চপাস্ট সে খুব ভালো করেই আয়ত্তে নিয়ে নেয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেন সে একজন সেনাবাহিনীর সদস্য হবেন। মনেপ্রানে বিশ্বাস নিয়ে তিনি সামনের পথচলা শুরু করেছিলেন। ২০ বছর বয়সে হঠাৎ মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং চুপিচুপি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকা:

১৯৬৭ সালে ১৬ ডিসেম্বর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। এর আগ থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছিলো ভয়াভহ যুদ্ধের খবর। উওপ্ত হয়ে উঠেছিলো পুরো দেশ।স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণ জানার পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা মিলে ব্রাহ্মনবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলেন। এন্ডারসন খালের পাড়েই তৈর করেছিলো এ ঘাঁটি। আখাউড়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপওার জন্য দরুইন গ্রামের দুই নম্বর প্লাটুনকে নির্দেশ দেন। সিপাহি মোস্তফা কামাল ছিলেন দুই নম্বর প্লাটুনে। মোস্তফা কামাল  বক্সার হিসেবে রেজিমেন্টে তার ক্ষ্যাতি ছিলো।১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চিত করার জন্য কুমিল্লা আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে রওনা দেন। পরের দিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা দরুইন গ্রামে গুলিবর্ষণ শুরু করে তখন মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে যোগদান করার আহ্বান জানান। সেখানকার মানুষের সুরক্ষা করার জন্য তারা এমন সিদ্ধান্ত নেন। ১১ নম্বর প্লাটুন ছিলেন মুনির দরুইন পৌছেন।সাথে সাথে মোস্তফা কামাল তার থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরীখায় অবস্থান নেন। বেলা ১১ টার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে গুলিবর্ষণ শুরু করে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয় এবং তার কিছুক্ষন পরে ঝড় থেমে যাওয়ার পর তারা আবার গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। ১২ টার দিকে তারা সরাসরি বাঙালি সাধারন মানুষের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমনের তীব্রতায় বেহাল হয়ে যান। অনেক মানুষ তখন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল কোন পথ না পেলে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। শত্রুরা যখন খুব বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঠিক সেই সময়ে মোস্তফা কামালের সহযোগীরা তাকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু মোস্তফা কামাল অন্য সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলে নিজে যুদ্ধ করার জন্য সেখানে থেকে যান এবং এল এম জি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। মোস্তফার ক্রমাগত নিখুঁত ফায়ারে পাকিস্তানিদের প্রায় ২০-২৫ জন হতাহত হন এবং তাদের সম্মুখ গতি মন্থর হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে মোস্তফার অবস্থানের উপরে মেশিনগান এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মোস্তফার এল.এম.জি.-র গুলি নিঃশেষ হয় এবং তিনি মারত্মক ভাবে জখম হন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর সৈনিকরা ট্রেঞ্চে এসে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

পুরস্কার সম্মাননা :

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীর শ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে। এছাড়া তার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। এছাড়া মোস্তফা কামালের নামানুসারে গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর৷

স্মৃতিসৌধ :

ব্রাহ্মনবাড়িয়ার আখাউড়ায় দরুইন গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়। তার পাশেই তার স্মৃতি রক্ষার জন্য তৈরি করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ।

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *