যাকাত কাকে বলে? ইসলামে যাকাতের বিধান ও যাকাত প্রদানের খাত

যাকাত ইসলাম ধর্মের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তাই যাকাত কাকে বলে, যাকাত কাদের উপরে ফরজ, যাকাত প্রদানের খাত কয়টি, যাকাতের বিধান কি- এই সকল বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। চলুন যাকাত সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জেনে নেই।

যাকাত কাকে বলে ও যাকাত শব্দের অর্থ

যাকাত আরবি শব্দ। যাকাত শব্দের অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিছন্নতা ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় বাৎসরিক ব্যয় মেটানোর পর বছর শেষে যদি সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা তার সমপরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকে, তবে উক্ত ধন-সম্পদের শতকরা আড়াই (২.৫%) ভাগ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত (৮) আটটি খাতে প্রদান করাকে যাকাত বলা হয়।

যাকাতের বিধান

যাকাত সকলের উপর ফরজ নয়। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানদের উপরেই কেবল যাকাত ফরজ।আর এক্ষেত্রে কয়েকটি শর্তও রয়েছে। যথা-

১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া।

২. মুসলমান হওয়া

৩. বালেগ হওয়া

৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া

৫. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া

৬. মাল বর্ধনশীল হওয়া

৭. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া

৮. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা

৯. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।

যে সকল জিনিসের উপর যাকাত দিতে হয়

জমাকৃত স্বর্ণ, জমির ফসল, ব্যবসায়ের পণ্য, গৃহপালিত গবাদি পশু, গরু, ছাগল, মহিষ, উট, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছলে যাকাত দিতে হয়।

যাকাত প্রদানের খাতসমূহ

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের ‘সূরা তাওবা’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, ‘নিশ্চয়ই যাকাত হচ্ছে ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য, দাস আজাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে।

সুতরাং, উক্ত আয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ কর্তৃক যাকাত প্রদানের আটটি খাতের  ব্যাপারে অবগত হই। নিচে উক্ত আটটি খাতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো-

১. ফকির: নিঃসম্বল ভিক্ষাপ্রার্থী।

২. মিসকিন: মিসকিন হলো ঐ ব্যক্তি, যে নিজের প্রয়োজন মেটাতেও পারেনা, মুখফুটে চাইতেও পারেনা

৩. যাকাত আদায়কারী ও হেফাজতকারী: এমন ব্যক্তি যে যাকাত আদায়, হেফাজত ও বন্টনের কাজে নিয়োজিত।

৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া।

৫. দাস মুক্তির জন্য: লিখিত চুক্তি বিনিময়ের যারা দাসে পরিণত হয়েছে তাদেরকে মালিকের নিকট থেকে ক্রয়ের মাধ্যমে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়।

৬. ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি: ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিকে তার ঋণ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাকাত প্রদান করা যাবে।

৭.আল্লাহর রাস্তায়: আল্লাহর রাস্তা বলতে জিহাদ, দ্বীনী-ইলম অর্জনের জন্য যাবতীয় মাধ্যমকে বোঝানো হয়েছে।

৮.মুসাফির: সফরে গিয়ে যার পাথেয় শেষ হয়ে গেছে, সে ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ প্রদান করে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে যাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে।

যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত প্রদান ফরয করা হয়েছে। কারণ, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজের ধনী- দরিদ্রের পার্থক্য দূরীভূত হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের পবিত্রতা নিশ্চিত হয়, সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এ জন্য পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় সামর্থ্যবানদের যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো।’

ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে রমযান মাসে যাকাত প্রদানের ফযিলত বেশি। কেননা, এই সময়ে আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব সত্তর (৭০) গুণ বাড়িয়ে দেন। সূরা মুযাম্মিলে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো’।

যাকাত আদায়ের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘যারা সোনা-রুপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও’। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে কপালে, পাঁজরে এবং পিঠে দাগ দেওয়া হবে। সেদিন বলা হবে এ তো সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। এখন সে সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ গ্রহণ করো।

আর যাকাত প্রদানকারীর জন্য সুসংবাদ দিয়ে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে। বুখারী শরীফে উল্লেখ আছে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তা’য়ালা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন সে যদি ওই সম্পদের যাকাত আদায় না করে তাহলে তার সম্পদকে কিয়ামতের দিন টাকপড়া বিষধর সাপের রূপ দান করা হবে, যার চোখের ওপর দুটি কালো দাগ থাকবে, যা তার গলায় বেড়ির মতো পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সাপটি তার চোয়ালে দংশন করে বলতে থাকবে আমি তোমার সম্পদ, আমিই তোমার মাল।

সুতরাং, পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা জরুরী।

আরও পড়ুন- কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

আরও পড়ুন- ত্যাগের উৎসব ঈদুল আযহার ইতিহাস ও তাৎপর্য