পবিত্র লাইলাতুল মেরাজ বা শবে মেরাজের অর্থ ও ইতিহাস
‘লাইলাতুল মেরাজ’ যা লোকমুখে শবে মেরাজ নামেও পরিচিত। যে রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর আমন্ত্রণে অলৌকিক উপায়ে উর্ধ্বাকাশে (আরশে আজীম) ভ্রমণ করেছিলেন এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। শবে মেরাজ মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত।
শবে মেরাজের অর্থ ও ইতিহাস
‘মেরাজ’ আরবি শব্দ। যার অর্থ উর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ। এই রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সজ্ঞানে এবং সশরীরে আল্লাহর নির্দেশে হয়রত মিকাইল (আ) ও হযরত জিবরাঈল (আ) এর সহযোগিতায় ‘বোরাক’ নামক বিশেষ বাহনে চড়ে মেরাজে বেরিয়েছিলেন। বোরাক একটি সাদা রঙের প্রাণী বিশেষ। বর্ণণায় এসেছ ‘বোরাক’ দৃষ্টির শেষ সীমা যতদূরে যায় তত দূরে এক এক একটি করে কদম রাখে!
মুহাম্মদ (সা.) এই বাহনের উপর সওয়ার হয়ে প্রথমে মসজিদুল হারাম এবং পরে মসজিদুল আকসা থেকে উপরের আকাশে আল্লাহর আরশে গমন করেছিলেন। এ সময় তিনি পর্যায়ক্রমে সপ্তম আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং তারপরে একাকী আল্লাহর প্রেরিত আরেক বাহন রফরফে করে আরশে আজীম পর্যন্ত ভ্রমণ করেন এবং মহান আল্লাহর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ লাভ করেন। এই ভ্রমণে নবীজী (সা.) জান্নাত ও জাহান্নামও পরিদর্শন করেন।
ঘটনাবলী
যখন নবীজিকে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সাতটি আসমানে বিশিষ্ট নবীগণদের রাখা হয়েছিল। প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.) এবং হযরত ইয়াহ’ইয়া (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহিম (আ.) উপস্থিত ছিলেন।
বর্ণিত আছে সপ্তম আসমানে বায়তুল মামূর নামক (বায়তুল্লাহ শরীফ তথা কা’বা শরীফের মত হুবহু) একটি ঘর আছে, যার যার চারপাশে ফেরেশতাগণ সারাক্ষণ তাওয়াফ করেন; আমরা যেমন কা’বা শরীফের চারপাশে তাওয়াফ করি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘এখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা তাওয়াফের জন্য আসেন যারা ভবিষ্যতে আর কোনদিন এখানে আসবেন না!’ ভাবা যায়! কত সংখ্যক ফেরেশতা মহান আল্লাহ তৈরি করে রেখেছেন? এবং সেই বায়তুল মামূরের পাশেই রয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা।
সিদরাতুন শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বরই গাছ’ আর মুনতাহা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সর্বশেষ গন্তব্য’। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সিদরাতুল মুনতাহার একটি বরই হাজারের মটকার সমান এবং পাতা হলো হাতির কানের মত বড়।’
এই সিদরাতুল মুনতাহার পাশে রয়েছে জান্নাত। রাসুল (সা) বলেছেন, “আমাকে সমস্ত স্তর ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে।সেখানে একটা ঘর দেখিয়ে ফেরেশতারা আমাকে বললেন এটা হচ্ছে ‘বাইতুল মা’মুর’ ,যার মধ্যে আপনাকে রাখা হবে। এটা শোনার পর আমি জিবরাঈল এবং মিকাঈল কে বললাম ‘আমি এই ঘরটায় একটু প্রবেশ করতে চাই।’ ফেরেশতারা বললেন, ‘এখনো আপনার সময় হয়নি , দুনিয়াতে এখনো আপনার জন্য হায়াত বাকী রয়েছে।’
নবীজিকে কলমের লেখার খসখস আওয়াজ শোনানো হয়েছিল। দুনিয়া সৃষ্টির শুরু থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত যা কিছু ঘটছে এবং ঘটবে তার সবকিছু ‘লওহে মাহফুজ’এ লিখে রাখা হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশে বিশেষ কলম এটা লিখে রেখেছে। আল্লাহ কলমকে হুকুম দিয়েছিলেন ﺍﻛﺘﺐ অর্থাৎ তুমি লিখে ফেল। কলম বলেছিল ﻣﺎﺫﺍ ﺍﻛﺘﺐ অর্থাৎ কি লিখব? আল্লাহ বলেছিলেন ﺍﻛﺘﺐ ﺍﻟﻘﺪﺭ ﻓﻜﺘﺐ ﻣﺎﻛﺎﻥ ﻭﻣﺎﻫﻮ ﻛﺎﺋﻦ ﺍﻟﻲ ﺍﻻﻳﺪ অর্থাৎ তাকদীর লেখ। তখন আল্লাহর হুকুমে কলম যা কিছু হয়েছে এবং হবে সবকিছু লিখে ফেলে। ‘লওহে মাহফুজ’ হল বিশেষ একটা সংরক্ষিত ফলক যাতে আদি-অন্তের সবকিছু লিখে রাখা হয়েছে। বর্ণণায় রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘লওহে-মাহফুজে’ যে কলম লিখেছিল, কলমের সেই লেখার খসখস আওয়াজ আমাকে শোনানো হয়েছে।
নবীজী হয়রত জিবরাঈলকে (আ.) দেখেছিলেন। নবী বলেন , ‘ জিবরাঈল (আ.) এর ছয়শত ডানা আছে এবং তা এত বড় বড় যেন দৃষ্টিসীমা ঢেকে গিয়েছে।’
নবীজি একাই আরো উর্ধ্বে আল্লাহর সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি হযরত জিবরাঈল (আ.) কে আরো উপরে নিয়ে যেতে বললে জিবরাঈল (আ.) অপারগতা প্রকাশ করেন এবং নবীজীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন তার আর উপরে যাওয়ার অনুমতি নেই।
অতঃপর নবীজী আল্লাহর সাথে একাকী সাক্ষাত করে পৃথিবীতে ফেরত আসেন এবং ফজরের নামাজ আদায় করেন। এই ঘটনা কুরআনেও আছে, সহীহ হাদীসে আছে। কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে তার ঈমান থাকবে না। কোন যুক্তিতে ধরুক বা না ধরুক, বিজ্ঞান এটাকে স্বীকার করুক আর না করুক, তবুও মেরাজ আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে।
পরের দিন রাসূল(সা.) ফজরের নামাযের পর সাহাবায়ে কেরামকে এই মেরাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন যে, দু’জন ফেরেশতা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান। সেখান থেকে সপ্তম আসমানের উপর পর্যন্ত আমি পৌঁছি। আল্লাহর দরবার পর্যন্ত পৌঁছি। আল্লাহর সাথে কথা হয়েছে। আল্লাহপাক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি বিস্তারিত ঘটনা বয়ান করে শোনান।
এই ঘটনা যখন বয়ান করেন তখন মক্কার কাফের নেতৃবৃন্দ এটা শুনে উপহাস শুরু করল যে, এটা কাল্পনিক ঘটনা। এক রাতের ভিতর সাত আসমানের উপরে যাওয়া আবার ফিরে আসা এটা কিভাবে সম্ভব? এটাতো পাগলের প্রলাপ! তারপর কাফেররা ছুটে গেল হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর কাছে। তারা বলল,’ মুহাম্মাদের বড় শিষ্যের কাছে গিয়ে দেখি সে কি বলে?’ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) ঐ দিন ফজরের জামাতে ছিলেন না। রাসূল (সা.) এর মুখ থেকে তখনও ঘটনা তিনি শোনেননি। কাফেররা তাঁর কাছে গেল। গিয়ে বলল,’যদি কোন লোক বলে যে, সে রাতের অল্প সময়ের ভিতরে সাত আসমানের উপর পর্যন্ত গিয়েছে, আবার ফজরের আগে দুনিয়ায় ফিরে এসেছে? তুমি কি তা বিশ্বাস করবে?’
জবাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. জিজ্ঞাস করলেন, ‘কে বলেছেন?’ তারা বলল, ‘তোমাদের নবী!’ হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘তাহলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি সত্যই বলেছেন।’
যেহেতু নবীজীর অপর নাম ‘আল-আমিন’ মানে বিশ্বাসী। এতেও কাজ না হওয়ায় কাফেরগণ পুনরায় নবীজীর কাছে গিয়ে মসজিদুল আকসার দরজা কয়টা , সিঁড়ি কয়টি এসব উদ্ভট প্রশ্ন করতে থাকে। নবীজী বলেছিলেন ‘আমি এত পেরেশানির মধ্যে আর কখনোই পড়িনি!’
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন, এবং পবিত্র শবে মেরাজের সমস্ত আমল সঠিক ভাবে পালন করার তৌফিক দান করুন আমীন।