ফুটবল বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ-গোলদাতা
২০২২ কাতার বিশ্বকাপ শেষ হবার পর পার হয়ে গেছে বেশ কিছু মাস। মরুর বুকে চলা এই বিশ্বকাপ ঝড় তুলেছিল রেকর্ডবুকে। প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে মরক্কোর শেষ চারে জায়গা করে নেয়া, লিওনেল মেসির অতিমানবীয় পার্ফমেন্স, ফাইনালে কিলিয়ান এমবাপ্পের হ্যাট্রিক কিংবা এক আসরে সর্বোচ্চ গোল… সবমিলিয়ে গোলের হিসেবে অনবদ্য এক বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছে কাতার।
২০২২ বিশ্বকাপে গোলের সাথে নিয়মিত সখ্যতা ছিলো কিলিয়ান এমবাপ্পের। পুরো টুর্নামেন্টে করেছেন ৮ গোল। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তার এমন পার্ফমেন্স শঙ্কায় ফেলেছে বিগত সব বিশ্বকাপের রেকর্ডকে। মাত্র দুই বিশ্বকাপ খেলেই বিশ্বকাপে এমবাপ্পের মোট গোল এখন ১২ টি। ফুটবল বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন জার্মান কিংবদন্তী মিরোস্লাভ ক্লোসা।
চলুন এক নজরে দেখে নেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের
মিরোস্লাভ ক্লোসা (জার্মানি) – ১৬ গোল
২০১৪ বিশ্বকাপে মিরোস্লাভ ক্লোসাকে ব্রাজিলের প্লেনে নেয়া হয়েছিলো কেবল একটি উদ্দেশ্যে। সেটি হচ্ছে নতুন রেকর্ড গড়া। দলে ইনফর্ম ফরোয়ার্ড আন্দ্রে শুরলে কিংবা টমাস মুলার থাকলেও ক্লোসা সুযোগ পাচ্ছিলেন নিয়মিত। বয়স সঙ্গ না দিলেও রেকর্ড অবশ্য করেছিলেন এই জার্মান গোলমেশিন। সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ৭-১ গোলের জয়ে করেছেন রেকর্ডভাঙ্গা গোল। বিশ্বকাপে ১৬ গোল নিয়ে রেকর্ডবুকের শীর্ষে আছেন ক্লোসা।
ক্লোসার বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সালে। সেবার তিনি করেছেন ৫ গোল। হ্যাট্রিক ছিলো একটি। ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজ দেশ জার্মানিতে করেন আরও ৫ গোল। সেবার সর্বোচ্চ গোলদাতার গোল্ডেন বুটও জেতেন এই ফরোয়ার্ড। ২০১০ বিশ্বকাপে করেন ৪ গোল। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপে ২ গোল করে হয়ে যান বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
রোনালদো নাজারিও (ব্রাজিল) – ১৫ গোল
তাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন। দ্য ফোনোমেনন খ্যাত ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী রোনালদো নাজারিও বিশ্বকাপ গোল করেছেন ১৫ টি। এর মাঝে কেবল ২০০২ বিশ্বকাপেই করেছেন ৮ গোল! ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারটা কখনোই খুব মসৃণ ছিল না রোনালদোর। বারবার চোঁটের কারণে ছিটকে গেছেন। ইতিহাসের অন্যতম সেরা হলেও খেলতে পেরেছেন মোটে ৩টি বিশ্বকাপ।
রোনালদোর বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৮ বিশ্বকাপে। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে সব আলো ছিলো তার উপরে। ৫ গোল করে দলের আস্থার প্রতিদানও দেন দ্য ফনোমেনন। কিন্তু ১৯৯৮ ফাইনালে আরেক কিংবদন্তী জিনেদিন জিদানের জাদুতে ম্লান হয়ে পড়েন রোনালদো।
২০০২ বিশ্বকাপকে বলা যেতে পারে রোনালদোর বিশ্বকাপ। ফাইনালে দুই গোলসহ করেছেন মোট ৮ গোল। পেয়েছিলেন গোল্ডেন বুট। অদ্ভুত চুলের ছাঁট আর পায়ের কারুকাজ দুই মিলিয়ে রোনালদো হয়ে উঠেন ২০০২ বিশ্বকাপের পোস্টারবয়।
২০০৬ বিশ্বকাপে রোনালদো এসেছিলেন অনেকটা নিজের ছায়া হয়ে। ইনজুরির কারণে মুটিয়ে গিয়েছিলেন অনেক। খেলার ধারও ছিলো পড়তির দিকে। কোয়ার্টার ফাইনালে আরো একবার জিদানের সামনে কাটা পড়েন তিনি। তবে তার আগে ৩ গোল করে সে সময়কার রেকর্ড ভাঙেন রোনালদো নাজারিও।
জার্ড মুলার (জার্মানি) -১৪ গোল
৬৮ ম্যাচে ৬২ গোল! নিজের ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জেতানো গোল। জার্মান কিংবদন্তী জার্ড মুলারের গোল করার অমন সহজাত স্বভাবের জন্য তাকে ডাকা হতো ‘ডার বোম্বার’। মাত্র ২ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলেও ১৪ গোল করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এই জার্মান গোলমেশিন। ৭০’ এর বিশ্বকাপ বলতেই যখন সবার মুখে চলে আসে শৈল্পিক ব্রাজিলের নাম, সেই বিশ্বকাপে অন্যরকম আলো কেড়েছিলেন জার্ড মুলার। অবিশ্বাস্য ১০ গোলের ট্যালি নিয়ে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা।
মাত্র ১৩ ম্যাচেই ১৪ গোল করেছিলেন দ্য বোম্বার জার্ড মুলার। ১৯৭০ এর বিশ্বকাপে ৩ দিনের ব্যবধানে বুলগেরিয়া আর পেরুর বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। আর ১৯৭৪ বিশ্বকাপে মোটে চার গোল করে জিতে নিয়েছিলেন আরাধ্য বিশ্বকাপটাও। ফাইনালে তার গোলেই হার মানতে হয়েছিলো ইয়োহান ক্রুইফের টোটাল ফুটবলকে। বিশ্বকাপে তার ১৪ গোলের এই রেকর্ড অক্ষুন্ন ছিলো মোট ৩২ বছর।
জাঁ ফন্টেইন এবং লিওনেল মেসি (১৩ গোল)
ফ্রান্সের কিংবদন্তী জাঁ ফন্টেইন এমন এক রেকর্ড গড়ে গিয়েছেন যা ভাঙ্গা হয়ত যে কোনো ফুটবলারের জন্য কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। মাত্র একবারই বিশ্বকাপে এসেছিলেন ফন্টেইন। ১৯৫৮ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে ফন্টেইন খেলেছিলেন ৬ ম্যাচ। করেছেন দুই হ্যাটট্রিক। আর মোট গোলসংখ্যা ১৩। এক আসরে তারচেয়ে বেশি গোল নেই আর কারোরই। মাত্র ২১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ৩০ গোল করেছিলেন এই ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার। আর ৫৮ বিশ্বকাপের পর আর কখনোই বৈশ্বিক আসরে নামতে পারেননি তিনি।
২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে ২ গোল করে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডবুকে উঠে এসেছেন তর্কাতীতভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। নিজের ৫ম বিশ্বকাপে এসে মেসি করেছেন ৭ গোল। মাঝে ২০১০ বিশ্বকাপে গোল না পেলেও বাকি চার বিশ্বকাপেই পেয়েছেন জালের দেখা। ২০০৬ বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচেই গোল দিয়ে বিশ্বকে জানিয়েছিলেন নিজের উপস্থিতি। ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসি করেছেন ৪ গোল। সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে তার হৃদয় ভাঙার গল্পটাও সবার জানা। ২০১৮ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে পেয়েছিলেন একমাত্র গোল। তবে তিনি নিজের সব আক্ষেপ মিটিয়েছেন ২০২২ বিশ্বকাপে। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের সব পর্বেই গোল করা খেলোয়াড় হয়েছেন তিনি। ৭ গোল করে নিজের মোট গোলসংখ্যা ১৩ তে নিয়ে থেমেছেন এই ক্ষুদে জাদুকর।
পেলে, এমবাপ্পে (১২ গোল)
ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে খেলেছেন মোটে ৪টি বিশ্বকাপ। এর মাঝে শিরোপার স্বাদ পেয়েছিলেন ৩ বারই। কালোমানিক খ্যাত পেলের বিশ্বকাপ গোলসংখ্যা ১২টি। ১৯৫৮ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপে করেছেন ৬ গোল। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের সাথে হ্যাট্রিক আর ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে শিরোপা জিততে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন পেলে। ১৯৬২ বিশ্বকাপটা অবশ্য ভালো যায়নি পেলের জন্য। মেক্সিকোর সাথে ১ গোল করেই থেমেছিলো তার যাত্রা। এরপর ১৯৬৬ সালেও পেলের গোল ছিলো ১টি। আর ১৯৭০ সালে নিজের শেষ বিশ্বকাপে করেছিলেন ৪ গোল।
হালের সেনসেশন এমবাপ্পে মাত্র দুই বিশ্বকাপেই উঠে এসেছেন শীর্ষ গোলদাতার তালিকায়। ২০১৮ সালে নিজের প্রথম আসরেই ৪ গোল করেন এমবাপ্পে। পেলের পর ২য় কিশোর হিসেবে গোল করেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে। তবে ২০১৮ কাতার বিশ্বকাপে যেন নিজের উপস্থিতি অন্যভাবেই জানান দিয়েছেন এই পিএসজি তারকা। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া এবং ডেনমার্কের বিপক্ষে মোট তিন গোল পেয়েছিলেন। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডে পোল্যান্ডের সাথে জোড়া গোল করে কোয়ার্টার আর সেমিতে ছিলেন গোলশূন্য। আর ফাইনালে তো রীতিমতো হ্যাটট্রিকই করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে মাত্র ২ বিশ্বকাপেই তার গোল ১২ টি। রের বিশ্বকাপেই এমবাপ্পে হয়ত ছাড়িয়ে যাবেন মিরোস্লাভ ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ডকে।
বিশ্বকাপে ১১ গোল করে এই তালিকার পরের স্থানে আছেন জার্মানির আরেক কিংবদন্তী জার্গেন ক্লিন্সম্যান এবং হাঙ্গেরির স্যান্ডোর ককসিচ। আর ১০টি করে গোল করেছেন আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার, জার্মানির টমাস মুলার এবং হেলমুট রান। সমানসংখ্যক গোল আছে পেরুর তেয়োফিলো সুবিয়াস আর পোল্যান্ডের জর্জ লাটোর।
আরও পড়ুন- বিশ্বকাপে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোঃ সম্ভাবনার শুরু থেকে হতাশার শেষ