ঘূর্ণিঝড় সিডর নিয়ে যত প্রশ্ন
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশকে তার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে অনেকটা বিচ্যুত করে দিয়েছিল যে সকল প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় “সিডর” অন্যতম। বলা হয়ে থাকে যে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি সাধনকারী সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো সিডর।
সিডর নামকরণের কারণ ও সিডর অর্থ
সাধারণত যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামকরণ করা হয় এর উৎপত্তিস্থলের স্থানীয় ভাষার মাধ্যেম। মূলত সিডর একটি সিংহলি বা শ্রীলঙ্কান শব্দ। সিডর শব্দটির অর্থ হচ্ছে চোঁখ। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী একে চোখের মতো উল্লেখ করার ফলে এরকম নামকরণ করা হয় ।
সিডরের গতিবেগ ও ধরণ
সিডরের গতিবেগ ছিল ২৬০ কিলোমিটার/ ঘন্টা থেকে ৩০৫ কিলোমিটার/ ঘন্টা, যার ফলে সাফির- সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী সিডরকে ৫ ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড় বলে আখ্যায়িত করা হয়। বলা বাহুল্য যে, এটি ছিল একটি সুপার ঘূর্ণিঝড়।
উৎপত্তিস্থল
বঙ্গোপসাগর এলাকাকে লন্ডভন্ড করে দেয়া এই ঘূর্ণিঝড়টির উৎপত্তি মূলত উত্তর ভারত মহাসাগরের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে। ১৪ নভেম্বর ২০০৭, প্রতিবেশী দেশের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সংকেত জারি করে। একই দিন রাত ৮টার পর বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের সব কার্যক্রম ও রাত ১০টায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়। ঝড়ের পূর্বাভাসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থার আওতায় আসে। পরদিন থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে নৌ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় সিডর মারাত্মক আঘাত হানে। সিডরের প্রভাবে উপকূলে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো ভরা জোয়ারের সমেয় সিডর উপকূলে আঘাত হানে, ফলে প্লাবন কম হয়েছে, নতুবা এর ফলে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে মৃত্যুর মিছিল নেমে আসতো।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ
তৎকালীন আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২.৩১ বিলিয়ন ডলার।
২০০৭ সালের ১৩ই নভেম্বর থেকেই দেশের আকাশ কিছুটা মেঘলা ছিলো, আবহাওয়া অফিস থেকে প্রথমে ৫ নম্বর সংকেত দেওয়া হয়। এরপর ১৪ই নভেম্বর রাতে ৮ নম্বর সংকেত দেওয়া হয়। এদিন সন্ধ্যার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো মানুষে ভরে যায়, পরের দিন আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকায় অনেকেই নিজের বাড়িতে ফিরে যায়। কিন্তু একটু জিরিয়ে নিয়ে সিডর আবার আক্রমণ শুরু করে। বলাবাহুল্য যে, ঘূর্ণিঝড় তার গতিপথে নেমে যাওয়া কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদের আলামত। এর মাধ্যমে সে থেমে শক্তি সঞ্চয় করে আরো দুর্বার হয়ে ওঠে।
এরপর ১৫ই নভেম্বর সকাল থেকেই ঘোষণা আসে যে সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়টি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। এই ঘোষণা বাংলাদেশের মানুষের কাছে রাখাল বালকের গল্পের প্রবঞ্চনা বলে মনে হয়েছিলো। তারা বাড়ি থেকে আবার নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। অতঃপর সন্ধ্যার পর থেকেই ঝড়ের গতি বাড়তে থাকে, আনুমানিক রাত ৯টার দিকে সিডর প্রথম আঘাত হানে সুন্দরবনের কাছে দুবলার চরে। এরপর বরগুনার পাথরঘাটায় বলেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে। লন্ডভন্ড হয়ে যায় বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল। বিশেষ করে বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরাসহ দেশের প্রায় ৩১টি জেলায় সিডর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
সিডরের প্রভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ঝড় হওয়ার সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, গাছপালা উপড়ে যায়, বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়।
সিডরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা
সিডরের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বাগেরহাট আর বরগুনাকে। শুধুমাত্র সরকারি হিসেবেই বরগুনায় মৃত্যুবরণ করে ১,৩৪৫ জন এবং আরো ১৫৬ জন নিখোঁজ ছিলো। আর বাগেরহাটে মৃত্যু হয় ৯০৮ জনের এবং প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ আহত হন। এরমধ্যে বাগেরহাটের শরণখোলাকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা হিসেবে ধরা হয়। সিডরে আক্রান্ত এলাকা সমূহে সুপেয় পানির তীব্র অভাব দেখা দেয়।
দুঃখের বিষয় হলো সিডর আক্রান্ত এলাকায় জায়গার অভাবে গণকবর দিতে হয়। এমনকি অনেক লাশের কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। কাপড়ের অভাবে লাশ দাফন করা হয় পলিথিন মুড়িয়ে। প্রাণঘাতী এই ঝড়ের একমাস পরেও ধানক্ষেত, জঙ্গল, বেড়িবাঁধ ও নদীর চরের আনাচকানাচে থেকে লাশের অংশবিশেষ, কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। কেউ কেউ অনেকদিন পর ফিরে আসেন, আবার কেউ স্মৃতি হারিয়ে আর বাড়িই খুঁজে পাননি।
সর্বোপরি, ২০০৭ সালের প্রাণঘাতী এই সিডর আমাদের জাতীয় জীবনে এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সিডর কালো এক অধ্যায় হিসেবেই আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।