বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
স্বাধীনতা বাংলার মানুষের অহংকার। শ্রম, মেধা,পরিশ্রম, চেষ্টা সব কিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ। একটি নিজস্ব পতাকা। দেশের মানুষকে শান্তিপূর্ন ভাবে বেঁচে থাকার জন্য ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি দেশ একটি ভুখন্ড। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্যে অন্যতম এক বীরশ্রেষ্ঠ হলেন হামিদুর রহমান। সাহসিকতা আর মেধা দিয়ে লড়াই করেছেন হানাদার বাহিনীর সাথে।
জন্ম ও পরিচয়:
১৯৫৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারী তদানিন্তন যশোর জেলার মহেশপুর উপজেলার খদ্দখালিশপুর গ্রামে হামিদুর রহমানের জন্ম। তার বাবা আক্কাস আলী এবং মাতা মোসা:কায়মুন্নেসা। তার বাবাও দরিদ্র একজন কৃষক ছিলেন এবং মা ছিলেন গৃহীনি। শৈশব কেটেছে তার খালিশপুরে। বড় হতে থাকে হামিদুর রহমান।
শিক্ষা জীবন:
প্রথমেই হামিদুর খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি হন। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন। এরপর আর পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেননি।
কর্ম জীবন:
হামিদুর রহমান ১১৯৭০ সালে হামিদুর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে৷ তাঁর প্রথম ও শেষ ইউনিট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ সেনাবাহিনীতে ভর্তির পরই প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাঠানো হলো চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে৷ ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ওখানকার আরও কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়৷
মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান এর ভূমিকা:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে আমরা কালোরাত্রি হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। কারন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা ২৫মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরিহ মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। হামিদুর চাকরিস্থল ছেড়ে নিজ পরিবারেী কাছে চলে যান। পর দিন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি মৌলভিবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ধলই বর্ডার চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে আউটপোস্টে যোগদান করেন। হামিদুর রহমান ৪ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হামিদুর ইস্ট বেঙ্গল সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাড়ি দখল করার অভিযান শুরু করেন। ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে অবস্থান নেন। সামনে দু প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। শত্রুর মুখোমুখি আসলেই একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্তা ফাঁড়ির কাছে পৌঁছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিবর্ষণ এর জন্য সামনের দিকে এগোতে পারেনি। অক্টোবর ২৮ তারিখে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। অবস্থা ভয়াভহ দেখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন গ্রেনেড হামলার। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় হামিদুর কে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্যে থেকেই গ্রেনেড নিয়ে হামলা শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে কিন্তু এরপর ই হামিদুর রহমান গুলিবৃদ্ধ হন সে অবস্থায় হামিদুর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুইজনের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ করেন। এভাবে আক্রমনের মাধ্যম হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান এবং শত্রুর মোকাবিলা করে তারা ফাঁড়িটি দখল করে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু এত পরিশ্রম করেও হামিদুর রহমান ফাঁড়ি দখল করা না দেখেই মৃত্যুর কোলে ডলে পড়েন। ফাঁড়ি দখলের পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা হামিদুর রহমান এর লাস উদ্ধার করেন। অতঃপর হামিদুর রহমানের লাস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে দাফন করা হয়। সাহসিক বীরের মৃত্যু আসন্না জেনেও যেমন লড়াই করে গেছেন এটা ইতিহাসে বিরল । ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর হামিদুর রহমানের মৃতদেহ নিজ দেশে ফিরেয়ে নেন সরকার। এরপর তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য হামিদুর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাছাড়া নিজের গ্রামের নাম খদ্দখালিশপুর পরিবর্তন করে হামিদনগর নামকরন করা হয়। হামিদুর রহমানের নামে তৈরি করা হয়েছে স্কুল, কলেজ। এবং একটি ফেরির নামকরন ও করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এই শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে গ্রামে লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে। প্রায় ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় এসব। ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কেন্দ্রীয় মিলনায়তন করা হয়েছে। আমারা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবেই স্মরন করে রেখেছি। সাধারন মানুষ হয়েও প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য যুদ্ধ করে অন্যতম হয়েছেন। শহীদদের স্মৃতি আর ত্যাগের বিনিময় অর্জিত এ দেশ ও জাতি। বাংলার ভূখণ্ডে চিরজীবন প্রতিটা শহীদ অমর হয়ে থাকবে। বাংলার মানুষের মনে তারা জায়গা দখল করে নিয়েছে তাদের পরিশ্রম আর কাজের মাধ্যমে। এজন্য ই আমরা বলি-