রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান
পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে। প্রায় ৩০টিরও বেশি দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তির আর্থিক, কারিগরি ও পরিবেশগত সুবিধাদির বিষয়টি বিবেচনায় এ প্রযুক্তি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনবিদিত। আজকের বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্প জ্বালানি সম্পদের অধিকারী উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মসূচিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অন্যতম বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি
২ নভেম্বর, ২০১১ তারিখে বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়ান ফেডারেশন সফরকালে (১৫ জানুয়ারি, ২০১৩) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রিপারেটরি স্টেজ অফ কন্সট্রাকশন) কার্যাদি সম্পাদনের জন্য স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তি( আইজিএ) এবং স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট এগ্রিমেন্ট এর ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (প্রথম পর্যায়) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
মালিকানাঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানায় আছে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানঃ অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট, রাশিয়া।
নির্মাণ কাজ শুরুঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে ২ অক্টোবর, ২০১৩ তারিখে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
অবস্থানঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর নামক স্থানে অবস্থিত। অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ন্যায় এটিও পানির চাহিদা মিটাতে পদ্মা নদীর পাশে অবস্থিত।
জ্বালানিঃ সাধারণ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টোরে ইউরেনিয়াম-২৩৩, ইউরেনিয়াম-২৩৫ এবং প্লাটিনিয়াম-২৩৯ ব্যবহৃত হয়। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ব্যবহৃত হবে।
চুল্লির ধরণঃ ভিভিইআর ১২০০এমডব্লিউ মডেলের চুল্লি। এই চুল্লিতে তাপ পরিবাহক হিসেবে ১৫০ এটম চাপের উচ্চচাপীয় পানি ব্যবহৃত হয়।
ক্ষমতাঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা বিশিষ্ট চুল্লি দুটির মাধ্যমে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট। চুল্লি দুটির মূল্য প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার এবং সম্ভাব্য লাইফ সাইকেল ৬০ বছর।
উন্নয়ন সহযোগীঃ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ডেভেলপমেন্ট এন্ড হরেন ইকোনোমিক অ্যাফেয়ার্স (ভিইবি)।
প্ল্যান্টের স্থায়িত্বঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থায়িত্ব ৫০বছর।
সম্ভাব্য ব্যয়ঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩.৫ বিলিয়ন ডলারের ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে দেবে রাশিয়া, বাঁকি ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করবে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই প্রকল্পের বাজেট আরো ৭৯২ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করে প্রায় ১৪.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়।
ভূমিকম্প সহনশীলতাঃ রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার (এমএসকে) স্কেলের ভূমিকম্প হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমেরও কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা (পিজিএ= ০.৩৩৩জি) সমজাতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যেমন ভারতের কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রার (পিজিএ=০.১৭২জি) প্রায় দ্বিগুণ।
সম্ভাব্য উদ্বোধনঃ ২০২৪ সাল।
বন্যা প্রতিরোধঃ ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প অঞ্চলের পানির উচ্চতা গত ১০০ বছরে কখনো ১৪.৩২ মিটার (এমএসএল) অতিক্রম করেনি। সর্বোচ্চ এ উচ্চতা ১৯৯৮ সালের বন্যায় রেকর্ড করা হয়। অধিকতর সুরক্ষার জন্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ম্যাক্সিমাম ডিজাইন বেসিস ফ্লাড লেভেল ১৯ মিটার (এমএসএল) বিবেচনা করে নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে বন্যায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়।
পানি সাশ্রয়ঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অত্যাধুনিক কুলিং টাওয়ার সংযোজনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পানির প্রয়োজনীয়তা নূন্যতম পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। এর প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য পদ্মা নদী থেকে যে পরিমাণ পানি (২.৬ কিউবিক মিটার/ সেকেন্ড) উত্তোলন করা হবে, শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর গড় পানি প্রবাহের (২৬৬ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড) শতকরা ১ ভাগেরও কম।
তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণঃ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা এতোই কম ও নগণ্য যে তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার শতকরা ১ ভাগেরও কম। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সর্বাধুনিক ডিজাইনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুরক্ষা ব্যবস্থা বিশিষ্ট জেনারেশন থ্রি প্লাস রিয়েক্টরসহ নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। এছাড়া পাঁচস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তেজস্ক্রিয়তা যাতে কোনোক্রমেই (প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা) বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্যানিটারি সুরক্ষা অঞ্চলের (৩০০ মিটার রেডিয়াস) বাইরে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালীন সময়ে বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, সরঞ্জাম স্থাপন, ওয়েল্ডিং সহ মূল নির্মাণ কাজের জন্য প্রায় ৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ এর আওতায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) একটি ১৩২/১১ কেভি উপকেন্দ্র ও প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ।
দেশের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণঃ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে মিশ্র জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় ৯ শতাংশ এই প্রকল্প সরবরাহ করবে।
৬ কোটি উপকারভোগীঃ রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে প্রায় ১৯.৩৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, যা ৬ কোটি মানুষ অথবা ১.৫ কোটি পরিবারের বার্ষিক বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণে সক্ষম।
নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসঃ জলবায়ু সংকট সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি অন্যতম। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সঞ্চিত শক্তি কাজে লাগিয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দীর্ঘমেয়াদে নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং অন্যান্য বিকল্প অপেক্ষা সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
কম মূল্যে বিদ্যুৎঃ প্রতি ঘন্টা প্ল্যান্ট চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হবে ৮ থেকে ১৪ ডলার। ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় বিক্রয়মূল্য হচ্ছে ৬.৩২ সেন্ট, যা বিশ্বের গড় বিক্রয়মূল্য (১০ সেন্ট) থেকে শতকরা প্রায় ৩৭ শতাংশ কম।
আরও পড়ুন- মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য
আরও পড়ুন- মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য
আরও পড়ুন- ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য
আরও পড়ুন- বঙ্গবন্ধু টানেল সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান