বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ও তাঁর বীরত্ব
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য দিতে হয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ। ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন সবার নাম না জানা গেলেও কিছু সংখ্যক মানুষের নাম জেনেছি যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য শহীদ হয়েছেন। পরবর্তীতে তাদেরকে বিভিন্ন উপাধি,খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ তাদেরই একজন। শুধু উপাধি পাওয়া মানুষগুলোই নয় এছাড়াও হাজারো মানুষ অবদান রেখেছে্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। আমরা আজকে জানবো বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ এর জীবন কাহিনী,মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান এবং তাকে কেন বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ এর জন্মস্থান ও পরিচয়:
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৬ সালে মহিষখোলা নড়াইল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মাতা জেন্নাতুন্নেসা।নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারত পরে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহন করেন। নূর মোহাম্মদ শেখ পেশায় ছিলেন একজন সৈনিক।
পারিবারিক অবস্থা :
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই মা বাবাকে হারিয়ে ফেলেন নূর মোহাম্মদ শেখ। মা বাবা হারানোর পর সোনালী শৈশবটা আর সোনালী হয়ে ওঠেনি। এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন নূর মোহাম্মদ শেখ।প্রাথমিকের পড়াশোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্তই তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯৫২ সালে নূর মোহাম্মদ নিজ গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষকের মেয়েকে বিবাহ করেন। ১৯৫৪ সালেই তার পরিবারে নতুন সদস্যদের আগমন ঘটে। ১৯৬৪ সালে তার দ্বিতীয় সন্তান শেখ গোলাম মোস্তফা জন্মগ্রহণ করেন।
নূর মোহাম্মদ শেখ এর কর্মজীবন:
নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাইফেলস এ যোগদান করেন। তিনি তার চাকুরিসূত্রে দিনাজপুরে থাকতেন। ১৯৭০ সালে ১০ জুলাই নূর মোহাম্মদ শেখ কে দিনাজপুর থেকে যশোরে বদলি করা হয়। সেখান থেকেই তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টরে তিনি যোগদান করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নূর মোহাম্মদ যশোরের শার্শা থানায় কাশিপুর সীমান্তে বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এভাবেই নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশের যুদ্ধে একটু একটু করে নিজেকে অগ্রসর করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নূর মোহাম্মদ শেখ অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তাঁর সাহস দিয়ে যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরোদ্ধে। দুর্লভ সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন তার সাহসিকতা। তাঁর এ সাহসিকতা দেখে হাজারো মানুষ মুগ্ধ হয়েছিলো এবং তারাও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। সবাইকে নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য ই তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে ।
নূর মোহাম্মদ শেখ শহীদ হওয়ার ঘটনাবলি:
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সূতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যুরোর সামনে যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদ শেখ কে অধিনায়ক করে গঠিত পাঁচ জনের সমন্বয়ে একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। আনুমানিক সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তিনদিক থেকে পেট্রোলটি ঘিরে ফেলে এবং গুলিবর্ষন শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পিছন থেকে পাল্টা গুলি চালায় পেট্রোলটি নিজেদের আয়ত্বে আনার জন্য কিন্তু সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এটা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা নিয়ে নেয় তাদের দখলে। এক সময়ে তাদের পাঁচজন সিপাহিদের মধ্যে একজন (নান্নু মিয়া)গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নূর মোহাম্মদ তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে হানাদার বাহিনীর উপর এল.এম জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেন। এমন পরিস্থিতিতে শত্রু পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। নূর মোহাম্মদ শেখ গুলিবর্ষণ থামানো মাত্রই শত্রু পক্ষ নূর মোহাম্মদ এর উপর গুলিবর্ষণ করে এবং তাতে নূর মোহাম্মদ শেখ আহত হয়ে পড়েন। নিজের শরীরের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সেখানেই তিনি শুয়ে পড়েন। মারাত্নভাবে আহত হয়ে যান তিনি। নিজেকে কোনভাবে মানিয়ে নিয়ে আবার উঠে পড়েন নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য। এল.এম জি সিপাহী মোস্তাফাকে বল্লেন নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে এবং মোস্তফার রাইফেল নূর নিয়ে নিলেন শত্রুদের সাথে আবারও লড়াই করার জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদেরকে নিরাপদে না নেন ঠিক ততক্ষণ তিনি শত্রুদের সাথে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে যান। শত্রুদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য তিনি হাজারো পন্থা অবলম্বন করেন। অন্য যে সিপাহিরা ছিলেন নূরের সাথে তারা যখন নূরকে ডাকলেন তিনি যায়নি বরং অন্য সব সিপাহিকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য বল্লেন। তিনি রনক্ষেত্রে রয়ে গেলেন। এরপর নূর মোহাম্মদ গুলিচালাতে শুরু করে আবার। এদিকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী সঙ্গে আধুনিক অস্ত্র থাকায় তিনি বেশিক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেননি ।এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের অনেক ক্ষতিসাধন করেন। পরে তিনি শত্রুপক্ষের হাতে শহীদ হন। শত্রু পক্ষ চলে গেলে সিপাহিরা এসে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ এর মৃতদেহ উদ্ধার করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়ার কারন:
নূর মোহাম্মদ শেখ তাঁর অসীম সাহসিকতার সাথে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করে গেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিজের বুদ্ধি দিয়ে আরও অনেক মানুষকে তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এভাবেই নিজের একটি দল গঠন করেন এবং যুদ্ধ করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
নূর মোহাম্মদ শেখ এর সমাধিস্থল:
শত্রুর গুলিবর্ষণে নিহত হওয়া বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখকে সমাহিত করা হয় যশোরের শার্শা থানার গোড়াপাড়া থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে কাশিপুর গ্রামে যেখানে তিনি চাকুরী ক্ষেত্রে থাকতেন। এভাবেই শেষ হয়ে গেলো একজন সাহসিক বীরের জীবন। আমরা যতদিন বেঁচে থাকবো স্মরন করবো তাদেরকে তাদের সাহসিকতাকে। শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ আমাদের জাতীর অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে চিরজীবন।