বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ হলো ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত বাংলার মানুষের একটি বিপ্লব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। এক মহিমান্বিত ইতিহাস রচিত হয়েছে ১৯৭১ সালে। রক্ত, অশ্রু আর অপরিসীম আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে একাত্তরে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অভ্যুদয় হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধা তথা জাতির বীর সন্তানেরা কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর নয় তারা পুরো বাঙ্গালী জাতির অহংকার। বীর শ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যুদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠর মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ অন্যতম। আমরা এখন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ সম্পর্কে জানবো।
জন্ম ও পরিচয়:
মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ৮ মে ফরিদপুর জেলার বোয়ালখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মেহেদী হাসান ৷ পিতা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ঈমাম ৷ মাতার নাম মকিদুন্নেসা। তাঁর দুই বোন জহুরা ও হাজেরা ৷
শিক্ষাজীবন:
বাবার কাছেই মুন্সি আব্দুর রউফের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিলো ৷ কিশোর বয়সে রউফ-এর পিতা মারা যান। ফলে তিনি উচচশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। মা অন্যের ফরমায়েশে কাঁথা সেলাই এবং শিকা তৈরির কাজ করে সংসার চালাতে থাকলেন। অভাবী মা মেয়ের বিয়েতে নতুন শাড়ির বন্দোবস্ত করতে পারলেন না। মেয়েকে পুরোনো কাপড়েই বিদায় দিলেন অচলে কান্না লুকিয়ে। মায়ের দুঃখ বুঝলেন মুন্সি আব্দুর রউফ, বললেন ” আমি বড় হয়ে যখন আয় করবো তখন অনেক নতুন শাড়ি কিনে দেব বুবুকে।” তিনি অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন”।
কর্মজীবনে মুন্সি আব্দুর রউফ:
সংসারের অভাব দেখে মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ই মে ২০ বছর বয়সে যোগদান করলেন ইপিআর-এ। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়োগ পেলেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে। তার ইপিআর নম্বর –১৩১৮৭। ছোট চাচা মুন্সী মোতালেব হোসেন ইপিআরে চাকরি করতেন। তিনিই আবদুর রউফকে ইপিআরে ভর্তি করে দেন। চাকরি পাওয়ার জন্য সে সময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো। চাকরি পাওয়ার পর, তাঁর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয়েছিল চুয়াডাঙ্গার ইআরপি ক্যাম্পে। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়। ছয় মাস পরে তাকে কুমিল্লায় নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৭১ সাল। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির কারণে সীমান্তে জারী হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। সবার ছুটি বন্ধ। মুন্সি আব্দুর রউফ চিঠি লিখেন মায়ের কাছে, দেশের অবস্থা ভালো হলে লম্বা ছুটি নিয়ে গ্রামে যাবেন। এর মধ্যেই ছোট বোনের বিয়ে ঠিক করতে বললেন। কথা দেন ছোট বোনের বিয়েতে নতুন শাড়িসহ উপস্থিত থাকবেন অবশ্যই। মাকে দেওয়া তার কথা রাখা হয়নি।
মার্চ ১৯৭১, আব্দুর রউফ ইপিআর এর ১১নং উইং চট্টগ্রামে কর্মরত। এমন সময় এলো ২৫ মার্চ কালরাত। পাকিস্তানী সৈন্যরা সারা দেশে চলাল ব্যাপক গণহত্যা। চট্টগ্রাম ইপিআর-এর বাঙ্গালি সদস্যদের পূর্ব সচেতনতা এবং সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে তারা রুখে দাড়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে। রাতেই তারা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। যোগ দেন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ এর ভূমিকা:
ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর ১৫০ জন সৈনিকের দায়িত্বে দেওয়া হয় রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌ পথে নিরাপত্তাবুহ্য তৈরির। এই সময় তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে মুন্সী আব্দুুর রউফসহ একদল মুক্তিযুদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিলেন বুড়িঘাটে। রাঙামাটি জেলার নান্নেরচরের অন্তর্গত বুড়িঘাট। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক বুড়িঘাট হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত। কালুরঘাট থেকে রামগড়ে যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল বুড়িঘাট দিয়ে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তখন ছিল না। কালুরঘাটের পতন হলে পাকিস্তানিরা বুড়িঘাট ও রামগড় দখলের জন্য তত্পর হয়ে ওঠে। ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি দল বুড়িঘাটে মুক্তিযুদ্ধাদের অবস্থানে আক্রমণ করে। সাতটি স্পিডবোট ও দুটি লঞ্চযোগে তারা সেখানে আসে। সংখ্যায় ছিল দুই কোম্পানির মতো। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ভারী অস্ত্রের মধ্যে ছিল ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অসংখ্য মেশিনগান।
পাকিস্তানিদের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধারা সংখ্যায় কম ছিলেন। তার পরও তাঁরা অসীম মনোবল ও দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শত শত তিন ইঞ্চি মর্টারের গোলা আর মেশিনগানের হাজার হাজার গুলিতে মুক্তিযুদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
মুন্সি আব্দুর রউফ যেভাবে শহীদ হয়েছিলেন:
পরিস্থিতির সুযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল তীরে নেমে মুক্তিযুদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। পাকিস্তানিদের অব্যাহত গোলাগুলির মুখে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়েন। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন কাভারিং ফায়ার। অসীম সাহসী মুন্সী আব্দুর রউফ স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। দলনেতা খালেকুজ্জামানকে তিনি বলেন, ‘স্যার, আপনি সবাইকে নিয়ে পশ্চাদপসরণ করুন। আমি পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করছি। এরপর মুন্সী আব্দুর রউফ একাই পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করতে থাকেন। এই সুযোগে তাঁর সহযুদ্ধারা নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করেন। রউফের অস্ত্রের নিখুঁত গুলিবর্ষণে পাকিস্তানিদের কয়েকটি স্পিডবোট ডুবে যায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
আকস্মিক ক্ষতিতে পাকিস্তানিদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা নিরাপদ দূরত্বে পিছু হটে যায়। পেছনে পাকিস্তানি বাহিনী পুনর্গঠিত হয়ে মুন্সী আব্দুর রউফের অবস্থান লক্ষ্য করে আবারও মর্টারের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। একটা গোলা সরাসরি রউফের দেহে আঘাত করে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর দেহ। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মাংসপিণ্ড। পরে সহযুদ্ধারা রউফের দেহের খণ্ডিত অংশ সংগ্রহ ও একত্র করেন। সেখানে একটি টিলার ওপর তাঁকে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করার কারণ:
তাঁর অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করেন। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনরারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করেন। মুন্সি আব্দুর রউফকে, মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতস্বরূপ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।
সমাধিস্থল:
রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে কাপ্তাই লেকের ছোট্ট এক দ্বীপে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাঙ্গালির এক বীর সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ। অথৈ নীল জল পরিবেষ্টিত সমাধি স্থলে লেখা “তুমি দূর্জয়,তুমি নির্ভীক মৃত্যুহীন এক প্রাণ” কথাগুলো যেন তার গৌরবজ্বল বীরত্বের এক অনন্য প্রকাশ।